কোথাও বিদেশি পার্কের আদলে, কোথাও গ্রামবাংলার হাতের কাজে আবার কোথাও প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র গানের সুরে সেজে উঠছে মণ্ডপ।
রবিবার সন্ধ্যায় শহরের পুরশ্রী মঞ্চে পুলিশের পুজো গাইড ম্যাপ উদ্বোধনের পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে সরস্বতী পুজোর কাউন্ট-ডাউন। সোমবার থেকে বিভিন্ন পুজো উদ্বোধনে শহরে আসছেন চলচ্চিত্র জগতের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, আসছেন বেশ কয়েকজন নেতা মন্ত্রীও।
মহকুমা পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বার অনুমোদিত পুজোর সংখ্যা প্রায় শ’খানেক। এছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে আরও চারশো পুজো। উত্সব সফল করতে ইতিমধ্যেই পুলিশ, দমকল, বিদ্যুত্-সহ কয়েকটি দফতর মহকুমা পর্যায়ে বৈঠকও সেরে ফেলেছে। কালনার এসডিপিও ইন্দ্রজিত্ সরকার বলেন, “আমাদের গাইড ম্যাপে শহরের ক্লাবগুলির অবস্থান স্পষ্ট ভাবে বোঝানো হয়েছে। ফলে দর্শকদের হয়রান হতে হবে না।” তিনি জানান, পুজোর দিনগুলিতে শহর জুড়েই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হবে। থাকবেন প্রচুর স্বেচ্ছাসেবীও। |
শহরের বেশ কয়েকটা ক্লাবের বাজেট এ বার চার লক্ষ টাকারও বেশি। থিম নিয়ে তো বটেই, মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা নিয়েও চলছে রেষারেষি। শহরের কালীনগর পাড়ার ক্লাব ওয়ান্টেড বয়েজের এ বারের থিম চাঁদ মামার দেশে। হুগলির ত্রিবেণীর শিল্পী মাধব চট্টোপাধ্যায় শিশুদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করেছেন মণ্ডপটি। আশি শতাংশ ফাইবার দিয়ে তৈরি এ মণ্ডপে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে শিশু কল্পনাকে। মণ্ডপের ভিতরে রয়েছে আইসক্রীম, চকোলেট থেকে পড়ার নানা বিষয়। আর প্রতিমা রয়েছেন আকাশে। অধিকারী পাড়ার রোহিনী তারা সমিতির পুজো এ বার পা রাখলো ৩৫ বছরে। তাদের এ বছরের থিম মহাশূন্যে বাগদেবী। উদ্যোক্তাদের দাবি, মণ্ডপে ঢুকেই চমকে যাবেন দর্শকেরা। আমলা পুকুর ইয়ং বয়েজের ভাবনা ইন্দোনেশিয়ার গ্রিন পার্ক। ছোট ছোট বাঁশ দিয়ে বৃত্তাকার মণ্ডপ, চারপাশে বাহারি গাছ দর্শকদের চোখ টানবে বলেই মনে করছেন উদ্যোক্তারা। মণ্ডপটি সাজিয়েছেন কৃষ্ণনগরের ভীমপুরের শিল্পীরা। মণ্ডপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি হয়েছে দশ ফুটের ডাকের সাজের প্রতিমা। বকুলতলার রুপালিকা ক্লাবের থিম পুতুলের দেশে। ছোট, বড় রঙবেরঙের প্রায় চার হাজার পুতুল দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। পুতুলগুলি তৈরি করেছেন অগ্রদ্বীপের শিল্পী অক্ষয় ভাস্কর। ক্লাবের সহ-সভাপতি অখিলেশ রায় বলেন, “পুতুল দিয়ে রামায়ণের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মণ্ডপে। আশা করি শিশুদের খুব ভাল লাগবে।” |
কিশোর সমিতির মণ্ডপ আবার তৈরি হয়েছে নানা ধরণের বাতিল চিকিত্সার সরঞ্জাম দিয়ে। যেমন, স্যালাইনের বোতল, সিরিঞ্জ, হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি, ওষুধের পাতা ইত্যাদি। স্যালাইনের বোতল দিয়ে তৈরি হয়েছে আস্ত ঝাড়বাতিও। মণ্ডপের ভিতর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মান্না দে-র বিভিন্ন গান, যেমন হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা, তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে, মা গো মা প্রভৃতি গানের দৃশ্য। গানের লাইনগুলির পাশেই মডেলগুলি রাখা হয়েছে। সরস্বতী পুজোয় দেখা মিলবে জীবন্ত মডেলেরও। লিচুতলার সমাপ্তি সঙ্ঘে উঁকি মারলেই দেখা যাবে পাগলা গারদ ও মানসিক হাসপাতালের একটি দৃশ্য। গারদের ভেতরের যন্ত্রণা দেখানো হবে জীবন্ত মডেলের মাধ্যমে। আর বাড়তি আকর্ষণ পেন্সিলের প্রতিমা। নেতাজি তরুণ সমিতির থিম এ বার অন্নপূর্ণা ভান্ডার। উদ্যোক্তারা জানান, বাদাম, মুগডাল, শুকনো লঙ্কা, ধান, চাল, আলু, সাবু, সর্ষে, রাজমা ইত্যাদি প্রায় ৩০ কুইন্ট্যাল শস্য সামগ্রী দিয়ে মণ্ডপটি তৈরি হয়েছে। মণ্ডপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শান্তিপুরের শিল্পী প্রদীপ পাল তৈরি করেছেন ডালের প্রতিমা। ক্লাব ইউনাইটেড আবার পুজোর নানা সামগ্রী যেমন, কুলো, মাটির সরা-সহ নানা জিনিস দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে।
বাজেট কিছুটা কম হলেও পুজোর উন্মাদনা আর উত্সাহে পিছিয়ে নেই গ্রামগুলিও। ধাত্রীগ্রাম, তেহাট্টা, উপলতি, রামেশ্বরপুরের মতো অজস্র গ্রামে মাস দেড়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। রামেশ্বরপুর যুবশক্তি ক্লাব যেমন এ বছর শ্রীলঙ্কার একটি প্রাচীন মন্দিরের আদলে পঞ্চাশ ফুটের মণ্ডপ তৈরি করছে। চটের উপর রেক্সিন ও চামড়ার কাজ করে মণ্ডপটি সাজানো হয়েছে। কৃষ্ণনগরের শিল্পী তৈরি করছেন সুতলির ঠাকুর। ক্লাব সম্পাদক আশুতোষ দাস জানান, উত্সবের দিনগুলিতে জলসার জন্য মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। মঞ্চের নাম রাখা হয়েছে সুচিত্রা সেনের নামে। উপলতি গ্রামের বামুনপাড়ার থিম বারো মাসে তেরো পার্বণ। গ্রামের শিল্পীরাই বানিয়েছেন মণ্ডপ।
সারা বছর গ্রামের রাস্তায় আলো না থাকলেও পুজোর দিনগুলি ঝলমলে রাখতে বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোক্তারা জেনারেটরের ব্যবস্থা রেখেছেন। যাতে রাতভর ঠাকুর দেখতেও অসুবিধেয় না পড়েন দর্শকেরা। এককথায়, বাণীবন্দনায় একসঙ্গে রাত জাগবে গ্রাম শহর। |
কালনায় মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি। |