|
|
|
|
অ-এ অনুষ্কা |
কলকাতায় এই প্রথম একক কনসার্ট তাঁর। শহরে পৌঁছে বাবাকে আরও বেশি করে মনে পড়ল
অনুষ্কাশঙ্কর-য়ের।
সে কথা একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেনও
তবলাবাদক তন্ময় বসু-কে। |
সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ অনুষ্কা।
ওহ্ তন্ময়, কী বলো! তবে, আমার একটু অদ্ভুত লাগছে যে, তুমি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছ!
হ্যাঁ। এই ইন্টারভিউটা আনন্দplus-এর জন্য।
ওহ্, ওকে ওকে। চলো, আমি রেডি।
প্রথমেই ঝুম্পা লাহিড়ি-র একটা প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি। সম্প্রতি ঝুম্পা কলকাতায় এসেছিল আর বলেছিল, কলকাতায় না থেকেও এই শহরটার সঙ্গে ওর একটা অদ্ভুত যোগাযোগ আছে। অনুষ্কাশঙ্করেরও কি সে রকম একটা সম্পর্ক আছে কলকাতার সঙ্গে?
হ্যাঁ, আছে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট আছে। আমি হাফ-বাঙালি, কিন্তু কোনও দিন কলকাতায় থাকিনি। সেই অর্থে আমি হাফ-তামিলও, কিন্তু কোনও দিন চেন্নাইতেও থাকিনি। ভারতে থাকা মানে আমি মূলত দিল্লিতেই থেকেছি।
কিন্তু হ্যাঁ, কলকাতার সঙ্গে অদ্ভুত একটা যোগাযোগ আমার আছে।
সেটা মনে হয় বাপির জন্য। বাপির কাছে কলকাতার এত কথা শুনেছি ছোটবেলা থেকে যে বলার নয়। আর সেটা খুব ডিপ কানেকশন। সেই কানেকশনটাই আমার মধ্যে ট্রান্সমিট হয়ে গিয়েছে। বলতে পারো, বাপির চোখ দিয়েই আমার কলকাতাকে দেখা। আর এ বার যখন ডোভার লেনে বাজাতে গেলাম, আরও বেশি করে বাপির কথা মনে পড়ছিল। ইট হিটস্ মি যে, এ বারে কলকাতায় বাপি আমার সঙ্গে নেই।
বুঝতে পারছি।
আর যেহেতু বাপি নেই, তাই যে মানুষগুলো এত দিন ধরে বাপিকে এত ভালবেসেছেন, তাঁদের সঙ্গে কানেক্ট করে আই ফেল্ট পিওর।
আমি কলকাতায় থাকি। আমি জানি কলকাতার মানুষের একটা অদ্ভুত সেন্স অব পজেশন আছে পণ্ডিতজিকে নিয়ে। ওদের কাছে রবিশঙ্কর, আমাদের লোক।
হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারি আমি।
সেই থেকেই আমার প্রশ্ন, আমি অনেক দিন ধরে তোমার সঙ্গে বাজাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কিন্তু পণ্ডিতজিকে হুবহু নকল করো না। ধীরে ধীরে তুমি নিজের একটা সাউন্ড তৈরি করে ফেলেছ।
তন্ময়, ডিফারেন্ট সাউন্ডটা কিন্থু আমি কনশাসলি করিনি। আমাকে বাপি একটাই কথা বলত, ‘মন থেকে বাজাও, তা হলে নিজের আইডেনটিটি পেয়ে যাবে।’ আমি স্টেজে তাই করি। সেই থেকেই বোধহয় এই আলাদা রকমের সাউন্ডটা আসে। এটা একদম কোনও টেকনিক্যাল ব্যাপার নয়, ব্যাপারটা স্পিরিচুয়াল।
|
|
আচ্ছা অনুষ্কা, একটা খটোমটো প্রশ্ন করি। অনেক সময় আমি শুনেছি লোকে বলেছে অনুষ্কাশঙ্কর আর কী বাজায়, রবিশঙ্করের মেয়ে বলে সুবিধা পায় একটা। অনবরত এই সমালোচনা তোমায় দুঃখ দেয় না?
আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি কী জিজ্ঞেস করতে চাইছ। আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়াটা শক্ত। দ্যাখো, তুমি তো জানো যে, একটা ক্রিটিসিজম থাকবেই। কেউ বলবে, তুমি খারাপ বাজাও। আমার খারাপ লাগে তখন, যখন কিছু মানুষ কনসার্টে না গিয়ে, আমার বাজনা না শুনেই এই রকম স্টেটমেন্ট করে দেয়। তখন খারাপ লাগে, দুঃখ হয়।
যদিও সমালোচনাকে আমি ভয় পাই না। কিন্তু না জেনে, না বুঝে, সুইপিং স্টেটমেন্ট করে দিলে হজম করাটা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।
আর ওরা আমাকে আর একটা তকমা দেয়। আমি নাকি ক্লাসিকাল মিউজিশিয়ান নই। আমি নাকি ফিউশন আর্টিস্ট। জানি না ওদের কথা শুনে হাসব না কাঁদব! তবে ফ্রাস্ট্রেটেড লাগে এই কথাগুলো শুনে।
হ্যাঁ, এক এক সময় এই রকম সুইপিং জাজমেন্ট মেনে নেওয়া সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছে খুব চাপের হয়ে যায়।
এগজ্যাক্টলি। আর দেখো, আমার বাবা রবিশঙ্কর বলে যে আমাকে একটা স্ক্রুটিনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তা তো স্বাভাবিক। সেখানে রবিশঙ্কর আমার বাপি বলে আমি খুশি থাকতে চাই। দু’জনের তুলনা নিয়ে একটুও ভাবতে চাই না। আর এই মিউজিক মানেই যে একটা যুদ্ধ, একটা তুলনা এই জিনিসটা আমার একদম ভাল লাগে না। আমরা ক্লা্যসিকাল মিউজিশিয়ানরা যে শিক্ষা পাই, তাতে তো সঙ্গীত আমাদের কাছে ধর্ম। যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিবেশটা তো ক্লা্যসিকাল মিউজিকের ইতিহাসে নেই।
আর এই পরিবেশটা তো দুঃখজনকও।
হ্যাঁ, আর দেখবে কনসার্টে কিছু লোক বসে থাকে। হাত গুটিয়ে, ভ্রু উপরে তুলে। বুঝুক বা না বুঝুক, তারা আসেই সমালোচনা করবে বলে। আরে সঙ্গীতটা প্রথমে অনুভব তো করো, তার পর তো সমালোচনা।
তার পর তো ওপিনিয়ন। তোমরা তো কিছু না জেনেই আমাকে ফিউশন আর্টিস্ট বলো। হ্যাঁ, আমার ক্রসওভার কনসার্ট করতে ভাল লাগে। আমি এনজয়ও করি। কিন্তু ওটা আমার আলাদা সত্তা। ওটার সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্কার কোনও বিরোধ নেই। সেতার নিয়ে যখন আমি বসি, সেখানে পুরোটাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ফ্রেমওয়ার্ক।
আচ্ছা, আবার ঝুম্পার প্রসঙ্গ টেনেই বলি, ও নাকি ভাল বাংলা বলতে না পারার জন্য রিগ্রেট করে। তোমারও কি তাই মনে হয়? বাংলা বলতে ইচ্ছে করে না তোমার?
অনেস্টলি বলছি, আমার ইচ্ছে করে না। এটা পড়ে হয়তো লোকে আমাকে ভুল বুঝবে। কিন্তু সত্যি বলছি আমার ইচ্ছে করে না। কলকাতাকে ছোট করছি না, তবে ইচ্ছে করে না।
কিন্তু এই কলকাতার মানুষই তো ডোভার লেনে তোমার কনসার্ট শেষ হওয়ার পর স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। তাও প্রায় সাড়ে চার হাজার লোক!
হ্যাঁ, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এটার তো দু’টো দিক আছে। প্রথমে ওরা আমাকে স্নেহ করে, কারণ আমি বাপির মেয়ে। তাই যেন আমি তাদের কাছে আলাদা কেয়ার পাই। কিন্তু এ বারে দেখলাম, প্রত্যেকটা মানুষ মন দিয়ে শুনল আমার বাজনা। শুনে ভাল বুঝেই নিশ্চয়ই আমাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিল। এটা অটোমেটিক্যালি হয় না।
মঞ্চে নিশ্চয়ই পণ্ডিতজিকে মিস করো?
সব সময় মিস করি। এখন একটা ভাল কিছু বাজালে প্রথমে মনে হয়, ইস্, এটা বাপি শুনলে কী খুশিই না হত! আর বাপির সঙ্গে বাজানোর চ্যালেঞ্জটা আলাদা ছিল। বাপি ওয়াজ আউটস্ট্যান্ডিং অন স্টেজ। আর তুমি তো জানো, বাপি প্র্যাকটিস রুমে যে মস্তানিটা করত, সেটাই স্টেজেও করত। কোনও আলাদা কিছু করত না কিন্তু। বাট হি ওয়াজ আ শো-ম্যান।
প্রথম প্রথম আমি কত ভুল করতাম। বাপি একটা জিনিস বাজাচ্ছে, বাজাতে বাজাতে হঠাৎ অন্য একটা ট্র্যাকে চলে গেল। আমি বুঝতে পারতাম না। বাপি পরে স্টেজে আমাকে বুঝিয়ে দিত। ধীরে ধীরে আমিও ইমপ্রুভ করতাম। তার পর বাপির সঙ্গে স্টেজে একটা অন্য কানেকটিভিটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু চোখে চোখে কথা হত। কোনও মানুষের সঙ্গে আর একজনের শুধু সঙ্গীতের মাধ্যমে এই কানেকশনটা কিন্তু অসম্ভব আধ্যাত্মিক একটা এক্সপেরিমেন্ট। ইট’স ভেরি স্পিরিচুয়াল।
|
|
জানি কী বলছ তুমি। আর তোমাকে বলি, আজ তবলাবাদক হিসেবে আমার নতুন কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু তোমার সঙ্গে যখন আমি বাজাই, আমার মনে হয় সেটা পণ্ডিতজির কাছে আমার গুরুদক্ষিণা।
থ্যাঙ্ক ইউ তন্ময়। আমরা ব্লেসেড কারণ, ওই মানুষটার সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করতে পেরেছি আমরা।
আচ্ছা, কখনও মনে হয়, রবিশঙ্করের মেয়ে না হলে অন্য রকম হতে পারত জীবনটা? এই ব্লেসিংয়ের সঙ্গে কার্সও তো রয়েছে কিছু...
অবশ্যই কার্স আছে। তুলনাটাই তো অভিশাপ। কিন্তু আমি জীবনটাকে ওই ভাবে দেখতে রাজি নই। আমার মনে হয়, আশীর্বাদগুলো অনেক বেশি।
পণ্ডিতজির কাছে বিলায়েত খান সাহেবের অনেক গল্প শুনেছি। আমি জানি, উনি অসম্ভব ভালবাসতেন বিলায়েতসাবের বাজনা। আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘তন্ময়, বিলায়েতের হাতটাই আলাদা।’ তুমি শুনেছ বিলায়েতসাবকে?
না, আমি শুনিনি। টু বি অনেস্ট, খুব ছোটবেলায় হয়তো শুনেছি। কিন্তু আমার মনে নেই।
আচ্ছা, বাঙালির একটা প্রিয় যুগলবন্দি আছে। সেটা হল, ‘পথের পাঁচালী’তে সত্যজিৎ রায় ও রবিশঙ্করের যুগলবন্দি। বাঙালির কাছে এই দুই মানুষের অন্য একটা জায়গা। গ্রেটেস্ট টু বেঙ্গলিজ...
তন্ময়, তুমি রবীন্দ্রনাথকে ভুলে যাচ্ছ।
না, ভুলছি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রয়েছেন, স্বামী বিবেকানন্দ রয়েছেন...
ওহ্, হ্যা।ঁ
আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গীত নিয়ে অনুষ্কাশঙ্করের মত কী? এটা আমরা কখনও শুনিনি।
আমার মনে হয়, সিনেমা আর সঙ্গীতের সর্বোচ্চ যুগলবন্দি হল ‘পথের পাঁচালী’র সাউন্ডট্র্যাক। যদি পারফেকশনের কোনও ফর্ম থেকে থাকে, তবে এটা সেটাই। পারফেক্ট। ১০-য়ে ১০। এর থেকে ভাল না কিছু হয়েছে। আর না কিছু হবে।
তুমি নিজে ভারতীয় সিনেমা দেখ?
খুব কম।
বলিউডের ছবি?
না না, একেবারেই না। যদি না আমাকে কেউ বলে এটা খুব ভাল ছবি, প্লিজ দেখো। না হলে আমি আর আমার স্বামী ইংরেজি ছবিই দেখি। আসলে আমার হিন্দি মেনস্ট্রিম সিনেমায় কোনও আগ্রহ নেই। ওটা ভীষণ ‘পপকর্ন’। আমার ‘পপকর্ন’য়ে কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু সেটার সঙ্গে আমি নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারি না।
|
|
তুমি তো নিজে অভিনয় করেছ। কলকাতায় দু’-তিন জন পরিচালক অসম্ভব ভাল কাজ করছেন। তাঁদের ছবিতে কাজ করতে ইচ্ছা করে না?
অভিনেত্রী হিসেবে একদম ইচ্ছে করে না। অভিনয় আমি করেছি, কিন্তু সেটা তো মজা করে। কিন্তু ওঁদের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করতে আমি অবশ্যই ইচ্ছুক। সেটা আমার কাছে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। আর আমি মনে করি বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাংলা ছবি হিন্দি ছবির চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
আমি বেশি রিলেট করতে পারি বাংলা ছবির সঙ্গে।
আচ্ছা, দুষ্টু সাংবাদিকের মতো একটা প্রশ্ন করি। নোরা না তুমি— বাপি কাকে বেশি ভালবাসত?
(দু’মিনিট হাসির রোল) তন্ময়, এটা এই সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে বুলশিট প্রশ্ন। হা হা হা। উত্তর দিচ্ছি না।
আরে আমি তো সাংবাদিক এখানে। বলো না।
(হেসে) কিছুতেই উত্তর দিচ্ছি না এটার।
আচ্ছা, সব সময় তুমি পণ্ডিতজির কথা এত বলো, তোমার মায়ের কথা তো বলো না। সেটা অবশ্য কোনও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী বলে নয়, আমরা কেউ-ই আমাদের মায়ের কথা বলি না।
অন্যদের কথা বলতে পারব না।
তবে আমি মায়ের ব্যাপারে কম কথা বলি। আসলে সব সাক্ষাৎকারেই তো বাপিকে নিয়েই প্রশ্ন করা হয়, আর সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার জীবনে মায়ের অনেক অবদান। প্রথমে যখন লন্ডনে থাকতাম, তার পর আমেরিকাতে যাই। এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশে আমাকে বড় করে তোলা তো মায়েরই অবদান।
আচ্ছা, তুমি তো মাইহার ঘরানাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছ। কখনও মনে হয় না, মাইহার ঘুরে আসি?
না তন্ময়, আমার একটুও ইচ্ছে করে না। ভগবানকে খুঁজতে হলে কি মন্দিরে যেতে হয় নাকি? আমি মাইহারের সঙ্গে যোগাযোগ অনুভব করি সঙ্গীতের মাধ্যমেই। ওখানে গেলে যে আলাদা করে বেশি যোগাযোগ অনুভব করব তা তো নয়। এটাতেও যদি কেউ আমাকে ভুল বোঝেন, তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু সত্যি করে বললে, এটাই আমি অনুভব করি।
অনুষ্কা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ খোলামেলা একটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য।
(হেসে) থ্যাঙ্ক ইউ, তন্ময়।
|
|
|
|
|
|