যে রাঁধে, সে চোলাইও বানায়।
বিষমদ কাণ্ডের পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় চোলাইয়ের আঁতুড়ে সব ভাটি বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। তা বলে চোলাই তৈরি কিন্তু বন্ধ হয়নি। বরং জয়নগর থানার গো-চরণে নবগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এখন বাড়িতে-বাড়িতে রান্নাঘরে চোলাই তৈরির ব্যবস্থা। রান্নাবান্নার ফাঁকেই চলছে মদ তৈরি।
বছর আড়াই আগেও গো-চরণের পূর্ব-পাঁচগাছিয়া এলাকায় শ’দুয়েক চোলাইয়ের ভাটি ছিল। ২০১১-র ডিসেম্বরে সংগ্রামপুরে বিষমদে ১৯৩ জনের মৃত্যুর পর থেকে সেগুলি বন্ধ। কিন্তু পূর্ব-পাঁচগাছিয়ার খাঁ-পাড়ায় একের পর এক বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই পাওয়া যাচ্ছে চোলাইয়ের কটূ গন্ধ।
পুলিশের কাছে খবর, গো-চরণের নানা গ্রামে অন্তত ৪০-৫০টি বাড়িতে রান্নাঘরে চোলাই তৈরি হচ্ছে। এক সময়ে যে মহিলারা ভাটিতে কাজ করতেন, তাঁরাই তৈরি করছেন। কয়েকটি বাড়িতে ঠেকও চলছে। তবে পরিচিত মুখ ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। সম্প্রতি জয়নগরের বেলিয়াচণ্ডী, কাঁটাপুকুরিয়া ও সরবেড়িয়ায় চোলাই খেয়ে সাত জনের মৃত্যুও হয়। তার পরেই চোলাই ধরতে নতুন করে অভিযান শুরু হয়েছে।
কী ভাবে হচ্ছে রান্নাঘরে চোলাই?
পূর্ব-পাঁচগাছিয়ার এক চোলাই কারবারি জানান, ভাটিতে যে পাতন পদ্ধতিতে চোলাই তৈরি হত, এখনও তা-ই করা হচ্ছে। রান্নাঘরে ছোট করে বন্দোবস্ত করে নেওয়া হয়েছে। ভাটিগুলিতে দিনে প্রায় হাজার লিটার চোলাই তৈরি হত। সেখানে একটি রান্নাঘরে সারা দিনে আট থেকে দশ লিটার চোলাই তৈরি হচ্ছে।
দিন কয়েক আগে এক বিকেলে খাঁ-পাড়ায় একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, আনাচে-কানাচে ছোট-ছোট লোহার ড্রামে গুড়, ইস্ট ও ইউরিয়া মিশিয়ে পচানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়ির চারদিকে বাঁশঝাড়ে সে রকম বেশ কিছু ড্রাম। কাছে গেলেই পচা গন্ধ। উঠোনের এক পাশে ১২ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া রান্নাঘরে বড় উনুন জ্বলছে। তাতে পচানো তরল ভর্তি লোহার ড্রাম বসানো। পিছনে ছ্যাঁদা করা অ্যালমুনিয়ামের হাঁড়ি উল্টে তার মুখে চাপা দেওয়া। সামান্য উপরে উল্টে ঝোলানো আছে মুখে লোহার জাল দেওয়া কড়াই। তার বেড় ধরে অ্যালুমিনিয়ামের চ্যানেল। এক পাশে ফুটো করে সরু পাইপ গোঁজা।
প্রায় থুতনি পর্যন্ত শাড়িতে মুখ ঢাকা দিয়ে বসা এক মহিলা এক নাগাড়ে হাতপাখা নেড়ে উনুনের নীচে হাওয়া দিয়ে চলেছেন। ড্রামের তরল ফুটে হাঁড়ির ছ্যাঁদা দিয়ে গলগলিয়ে বাষ্প উঠছে। লোহার জাল গলে তা গিয়ে ঠেকছে কড়াইয়ে। সেখানেই তা জুড়িয়ে তরল হয়ে কড়াইয়ের গা বেয়ে নেমে অ্যালুমিনিয়ামের চ্যানেল ধরে গড়িয়ে পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খানিক তফাতে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে চোলাই পড়ছে টপটপ করে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, পূর্ব-পাঁচগাছিয়ায় প্রায় হাজারখানেক পরিবারের রুটি-রুজি আসত ভাটি থেকে। সেগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই পেটের টানে রান্নাঘরে মদ তৈরি শুরু হয়েছে। এক ভাটিমালিকের কথায়, রান্নাঘরে তৈরি তাজা ১০ লিটার চোলাইয়ে জল মিশিয়ে ৩০-৪০ লিটার করা হয়। তা ৯০ মিলিলিটারের পাউচে ভরে এক-একটি ১২ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। দিনে ১০ লিটার তাজা চোলাই তৈরি করতে পারলে প্রায় হাজার চারেক টাকা মুনাফা। মাসে অনায়াসে লাখখানেক টাকা পকেটে আসে।
ভাটি বন্ধ হওয়ার পর চোলাইয়ের দাম আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তবুও চাহিদা মারাত্মক। মগরাহাট, জয়নগর, সংগ্রামপুর থেকে কারবারিরা সন্ধ্যের পর গো-চরণে এসে হাজির হচ্ছেন। বড়-বড় চটের থলেতে শয়ে-শয়ে চোলাইয়ের পাউচ পাচার হচ্ছে। কয়েক জন আবার ভাড়ায় আনা অটো গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে বস্তায় চোলাইয়ের পাউচ নিয়ে যান। এক-একটি অটোয় হাজার দুয়েক পাউচ পাচার হয়ে যায়। যে সব বাড়িতে লুকিয়ে ঠেক চলছে, সেখানেও চূড়ান্ত সতর্কতা। সংগ্রামপুরের এক নেশাড়ু জানান, রান্নাঘর লাগোয়া ঠেকে এখন আর মিনিট পনেরোর সময় বেশি বসতে দেওয়া হয় না। এক মুঠো ভিজে ছোলা আর চায়ের গ্লাসে দু’গ্লাস চোলাই। কুড়ি টাকা গুনে নিয়ে চোলাই দেওয়া হয়। পনেরো মিনিট পেরোলেই প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। এক ভাটিমালিকের কথায়, “এখন খুব বিপদে পড়ে গিয়েছি আমরা। এক দিকে পুলিশ ঝামেলা করছে। অন্য দিকে নেশাড়ুরা অগ্রিম টাকা দিয়ে যাচ্ছে। চোলাই না পেলেই ঝামেলা।” জেলার এক পুলিশকর্তার আক্ষেপ, সংগ্রামপুরে এত জনের মৃত্যুর পরেও নেশাড়ুদের এতটুকু হুঁশ ফেরেনি। কবে আবার কী ঘটে যায়, সেই আশঙ্কাতেই আপাতত কাঁটা হয়ে রয়েছে পুলিশ। |