নরেন্দ্র মোদী আগে যতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করুন না কেন, বুধবার ব্রিগেডের সমাবেশ থেকে শুধু সিপিএম নয়, তিনি নিশানা করবেন তৃণমূলকেও।
তৃণমূল নেত্রীর ব্রিগেড সমাবেশের এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্রিগেডে সভা করতে আসছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। সেই সভার আগে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের রাজনৈতিক নির্দেশিকা শুধু সিপিএম নয়, তৃণমূলের বিরুদ্ধেও তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানাতে হবে। মমতা সম্পর্কে বিজেপি কী রাজনৈতিক লাইন নেবে, তা নিয়ে দলের মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক চলছে। আপাতত ব্রিগেড সমাবেশের প্রাক্কালে বিজেপি নেতারা একমত, মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি সব সময়ে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী হলেও এখন পশ্চিমবঙ্গে আড়াই বছর ধরে শাসক দল মমতার তৃণমূল। কাজেই সংগঠন বাড়াতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি হোক বা স্বল্পমেয়াদি, সিপিএমের পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসকেও নিশানা করতে হবে। বুধবার ব্রিগেডের জনসভায় প্রধান বক্তা হিসেবে থাকছেন শুধু দু’জনই স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী ও দলের সভাপতি রাজনাথ সিংহ। বিজেপির তরফে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বরুণ গাঁধী অবশ্য এই সভার বক্তৃতা করবেন না বলেই ঠিক রয়েছে। তবে রাজ্য সভাপতি হিসেবে রাহুল সিংহ বক্তৃতা দেবেন। |
বিজেপির নারীবাহিনী। শনিবার মধ্য কলকাতার এক মিছিলে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
নরেন্দ্র মোদী বলেন, “প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতাদর্শ ও মতামত আছে। তৃণমূল কংগ্রেস তাদের বক্তব্য ব্রিগেডে পেশ করেছে। বিজেপি তাদের বক্তব্য পেশ করবে। এটাই গণতন্ত্র। কোনও ব্যক্তি আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে কোনও দলের জোট নেই। কাজেই স্বাধীন ভাবে বিজেপি তার মতামত প্রকাশ করবে।”
বিজেপি সূত্র বলছে, মোদী এর আগে মমতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। উত্তরপ্রদেশে প্রচারে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, মায়াবতী অথবা মুলায়ম সিংহ যাদব কেন্দ্রের সঙ্গে দর কষাকষি করেন সিবিআই তদন্ত তোলার জন্য। আর মমতা কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই করেন রাজ্যের স্বার্থে, রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া নিয়ে। কলকাতায় গিয়েও মোদী বলেছিলেন, গুজরাতে ক্ষমতায় আসার পর অতীতের কংগ্রেস শাসনের অপকর্ম থেকে মুক্ত করে রাজ্যের গর্ত বোজাতে তাঁর দশ বছর লেগেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের গর্ত বোজানোর কাজটি মমতার পক্ষে আরও কঠিন। বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনেও এক বার মমতার সঙ্গে কথা বলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন মোদী। কিন্তু মমতা রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে মোদীর বিরোধিতাতেই অটল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ বারে হ্যাটট্রিক করার পর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আসার জন্য মমতাকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু মমতা যাননি, কোনও প্রতিনিধিও পাঠাননি। যদিও উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ সিংহ যাদব এবং পঞ্জাবে প্রকাশ সিংহ বাদলের শপথে তৃণমূলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বরুণ গাঁধী এবং সিদ্ধার্থ সিংহ রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সঙ্গে একমত, যে মমতা কিছুতেই আর এনডিএ-তে যোগ দেবেন না। তাই আগেভাগে মমতা প্রশ্নে নরম মনোভাব নেওয়াটা সর্ম্পূণ অযৌক্তিক। তাতে বিজেপির আমও যাবে, ছালাও যাবে। বরং তৃণমূলকে পাওয়ার আশা ছেড়ে উচিত অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসন পাওয়ার চেষ্টা করা।
তবে লালকৃষ্ণ আডবাণী, অরুণ জেটলি এবং সবোর্পরি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ এখনও মমতা সম্পর্কে যথেষ্ট নরম। ক’দিন আগে মমতা দিল্লি এলে সংসদের সেন্ট্রাল হলে আডবাণী এবং রাজনাথ সিংহ তাঁর সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময়ও করেন। সুষমা স্বরাজ এবং অরুণ জেটলিও সংসদে মমতার আগের সফরে একই কাজ করেছিলেন। আডবাণী তাঁর ব্লগে এক বার মমতার সততা, তাঁর সিপিএম-বিরোধিতার প্রশ্নে এককাট্টা সংগ্রাম এ সবের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁকে এক সংগ্রামী নেতা বলে অভিহিত করেছিলেন। ক’দিন আগে দিল্লিতে বিজেপির জাতীয় পরিষদের বৈঠকেও আডবাণী ভারতের বহুমাত্রিক সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে সকলকে নিয়ে চলার কথা বলেছেন। |
|
কোনও ব্যক্তি আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য নয়।
পশ্চিমবঙ্গে
বিজেপির
সঙ্গে কোনও দলের জোট
নেই। কাজেই
স্বাধীন ভাবে
বিজেপি
তার মত প্রকাশ করবে।
নরেন্দ্র মোদী |
|
বস্তুত, হাওড়ায় লোকসভার উপনির্বাচনে রাহুল সিংহ প্রার্থী দেওয়ার পরেও রাজনাথ যে ভাবে প্রার্থী তুলে নিয়েছিলেন, তাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল মমতাকে একটা রাজনৈতিক বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী নিজেও যে এনডিএ-র সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে, তা নয়। চলতি নির্বাচনী প্রচারে তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচারই করছেন না। এমনকী গেরুয়া পঞ্জাবি পরা বা কপালে লাল তিলক লাগাতেও তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এটাও ঠিক, কলকাতায় গিয়ে মোদী দেখা করতে চাইলেও মমতা রাজি হবেন না। এই কারণে মোদী-অরুণ জেটলি-রাজনাথরা আরএসএস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০% সংখ্যালঘু ভোটের কথা ভেবে মমতা যদি মোদীকে এড়িয়ে চলেন এবং ব্রিগেডের সভায় দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে সমালোচনা করেন, তবে সে ক্ষেত্রে মোদীই বা কেন পশ্চিমবঙ্গে ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য একটা মরিয়া চেষ্টা করবেন না?
বিজেপির এক শীর্ষ নেতার ব্যাখ্যা, “তুমি তোমার ভোটের জন্য বিজেপির
বিরোধিতা করছ। বিজেপিও তেমন তার ভোটের জন্য, আসন লাভের জন্য তৃণমূলের সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধিতা করবে। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে সরব হবে। জেলায়-জেলায় সন্ত্রাসের বিষয়টি তুলে ধরবে। উত্তর-নির্বাচনী রাজনীতি ঠিক হবে ভোটের পরেই।” আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও সম্প্রতি কলকাতায় গিয়েছিলেন। তিনি উত্তরবঙ্গে গিয়ে আরএসএসের শিবিরে বক্তব্য রেখেছেন। এমনকী কলকাতায় গিয়ে কিছু বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে দেখাও করেছেন ভাগবত।
সর্ব অর্থে বাংলায় সড়গড় ভাগবত মনে করেন, ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিরও উচিত একলা-চলো নীতি নিয়ে চলা।
একটা সময়ে সিপিএমকে সরানোর জন্য মমতা মহাজোটের ডাক দিয়েছিলেন। তার পর মমতা এনডিএতে যোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলেছে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “২০১৬ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটকে অসন্তুষ্ট করে মমতার পক্ষে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপিকে সমর্থন
করা অসম্ভব।”
শহরের সর্বত্র মোদীর ছবি লাগানো হয়েছে। রাহুল সিংহ মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গেও একটা চোরা মোদী-ঝড় আছে। সেই ঝড়কে কাজে লাগানোর সুযোগ এসেছে। রাহুল ও বিজেপির নিচু তলার কর্মীদের কাছ থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার জন্য মোদী এবং রাজনাথের উপর প্রবল চাপ আছে। মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করলেও তৃণমূলকে নিশানা করতে বিজেপি নেতৃত্ব প্রস্তুত।
তবে জনসভার জন্য ব্রিগেডকে বাছা উচিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। রাজ্য বিজেপির কাছে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের অবশ্য বক্তব্য, “মোদী-ঝড় বলে কিছু নেই। উত্তর ভারতে যেখানে বিজেপির শক্তি রয়েছে, সেখানে তাঁর কিছু প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের প্রভাব রয়েছে, যেখানে বিজেপি নেই-ই। আর পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির কোনও অস্তিত্ব নেই। সুতরাং বামন হয়ে চাঁদ ধরার ইচ্ছে রাজ্যের অসাম্প্রদায়িক মানুষই ব্যর্থ করে দেবেন।” |
বুধবার ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদীর সভায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে আনার চেষ্টা করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। বলিউডের সুরকার বাপ্পি লাহিড়ি ইতিমধ্যেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। আসন্ন লোকসভা ভোটে বাংলা থেকেই লড়বেন তিনি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে পাশে পাওয়ারও চেষ্টা হয়েছে। এ বার সেই তালিকায় ঢুকলেন ঋতুপর্ণাও। তবে ঋতুপর্ণা এখনও তাঁর সিদ্ধান্ত জানাননি। |