সরকারি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তীব্র টাগ অব ওয়ার অব্যাহত। সিঙ্গাপুর বৈঠক আর মাত্র একশো চুয়াল্লিশ ঘণ্টা দূরে। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক পজিশন পেপার ঘিরে খেয়োখেয়ি বেড়েই চলেছে।
টেস্ট ক্রিকেটের একশো সাঁইত্রিশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তিনটে বিতর্ক হল অ্যাপারথাইড চালু থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা, প্যাকার-অধ্যায় এবং গড়াপেটা-কেলেঙ্কারি। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে সবচেয়ে বড় লাভাস্রোত যে সাম্প্রতিক মহাবিতর্ক তা নিয়ে কোনও তর্ক নেই।
ভারতীয় মহাজোটের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী মুখ হিসেবে এই বিতর্কে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকায়, আইসিসি-র প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এহসান মানি। সেই মানি শনিবার রাতে ইসলামাবাদ থেকে ফোনে উত্তেজিত ভাবে বললেন, “এত সহজে ভারত সব কিছু পাস করিয়ে নিয়ে যাবে মনে করার কোনও কারণ নেই। ৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে যদি সাত দেশকে ওরা নিজেদের পক্ষে পেয়ে যায়, সেটা ক্রিকেটের পক্ষে খুব দুঃখজনক দিন হবে। আমি অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে খুব ভেঙে পড়ব যে ব্যবসা খুন করে ফেলল ক্রিকেটের আত্মাকে।”
প্রাক্তন প্রবাদপ্রতিম কিছু ক্রিকেটারকে সঙ্গে পেয়ে গিয়েছেন মানি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরা। ক্লাইভ লয়েড। মাইকেল আথারটন। মাইকেল হোল্ডিং। ইমরান খান। ক্রিকেটাররা উত্তেজিত ভাবে দাবি তুলেছেন ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নিলে চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে যাবে খেলাটার।
ভারতীয় ক্রিকেটাররা মুখ খোলেননি। ধোনি সহ বর্তমান টিমের মুখ খোলার প্রশ্নও নেই। কিন্তু তাঁরা জানেনও না অজান্তে নিজের দেশের বোর্ড কোন চোরাবালিতে তাঁদের নিয়ে যাচ্ছে। শ্রীনিবাসনের ভারতীয় বোর্ড নিজেদের ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য বিভিন্ন দেশের বোর্ডকে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বাংলাদেশকে বলেছে প্রতি দু’বছরে অন্তত দু’বার করে তারা সিরিজ খেলবে। শ্রীলঙ্কাকে বলেছে প্রতি বছরে দু’বার করে খেলবে। এমনিতেই ভারতীয় ক্রিকেটাররা এত বেশি খেলতে হয় বলে গজগজ করেন। ভারতীয় বোর্ড যে সূচি তৈরি করেছে তাতে ধোনিদের খেলার সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। ভারতের তখন অন্তত দু’জন অধিনায়ক আর দু’টো প্রথম একাদশ তৈরি রাখতে হবে।
ভারতীয় বিড়ম্বনা সেখানেই শুরু এবং শেষ নয়। এখনও ভারতের প্রস্তাবে সই করতে গররাজি শ্বেতাঙ্গ দেশের ক্রিকেট-কর্তা এ দিন বলেছেন, “স্বল্পকালীন ফায়দা ভাবতে গিয়ে কী মূর্খামির মধ্যে ভারত নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে! যদি পাঁচ জনের কমিটি হয় ইতিমধ্যেই ভারত সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে রয়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যদি আরও দুই শ্বেতাঙ্গ দেশ ঢোকে তা হলে যে কোনও ক্রিকেটীয় ইস্যুতে ভারত ১-৪ হেরে যাবে।” |
কর্তাটি অবশ্য স্বীকার করছেন এখুনি সেই সম্ভাবনা নেই। এখন বেশির ভাগ দেশই ভারতের দেওয়া যাবতীয় টোপ নিয়ে আচ্ছন্ন। শ্রীলঙ্কা যেমন ভারতের সঙ্গে নিয়মিত ট্যুর ছাড়া অফার পেয়েছে আইসিসি-র হেড কোয়ার্টার সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। এ দিন কাজটা কত নৈতিক জিজ্ঞেস করায় প্রাক্তন আইসিসি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া বললেন, “এখুনি কোনও মন্তব্য করতে চাই না। দেখুন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়।” এহসান মানি কিন্তু পরিষ্কার বলছেন, “দুবাই থেকে কলম্বোয় সরানোর প্রস্তাবের মধ্যেই দুর্নীতি লুকিয়ে আছে।”
শুধু মানি নন, অনেকেই মনে করেন লন্ডন থেকে সরিয়ে দুবাইকে হেড কোয়ার্টার করা হয়েছে নানান সুবিধের জন্য। যেমন ইংল্যান্ডের তুলনায় সুবিধেজনক আয়কর ব্যবস্থা। ইউরোপ সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির শক্তিশালী অর্থনীতি। উন্নত পরিকাঠামো। আরও নানান কারণে। সেখান থেকে কী করে তৃতীয় বিশ্বের কলম্বো উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে যেখানে গৃহযুদ্ধ থেকে অর্থনীতি নানান ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আইসিসি-র রাজদরবারকে কেন পাশার তাস হিসেবে ব্যবহার করা হবে?
অনেকেরই মনে হচ্ছে আইসিসি-তে বড় তিন প্রধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হতে গিয়ে ভারত পেশাদার চিন্তাভাবনাকে হিমালয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেট কর্তা বললেন, “একদিন ভারত এই লোভের দাম নিজেরাই চুকোবে। সে দিন ওরা বুঝবে স্বল্পমেয়াদি ফায়দা দেখতে গিয়ে কী ভাবে খেলাটার নিয়ন্ত্রণ ওরা হারিয়ে ফেলল।”
ভারতীয় বোর্ড কর্তাদের অধুনা চ্যালেঞ্জ হল আগামী একশো চুয়াল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনও একটা দেশকে নিজের বাগে নিয়ে ফেলা। এখনও বেগড়বাই করে যাচ্ছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর দক্ষিণ আফ্রিকা। এদের যে কোনও একজনকে পক্ষে পেলেই পজিশন পেপার পাস হয়ে যাবে।
শনিবার তড়িঘড়ি করে কেন সিঙ্গাপুরে বৈঠক ডাকা হয়েছে তা নিয়ে বিরোধী ক্রিকেট কর্তাদের পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের বৈঠকের দু’দিন বাদে ভারতের আইপিএল কেলেঙ্কারি নিয়ে মুদগল কমিশনের রিপোর্ট বার হওয়ার কথা। সার্বিক ধারণা হল, শ্রীনিবাসন সেই রিপোর্ট বার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার ঝুঁকি না নিয়ে আগেই কাজটা সেরে ফেলতে চান। কে বলতে পারে রিপোর্টে সিএসকে সম্পর্কে তীব্র অসম্মানজনক মন্তব্য থাকবে কি না?
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ারম্যান ওয়ালি এডওয়ার্ডস এ দিন শ্রীনিবাসনের সমর্থনে বলেছেন, “ক্রিকেট বিশ্বের মোট আয়ের সিংহভাগ ভারতেরই প্রাপ্য।” ইংল্যান্ডের জাইলস ক্লার্কও তাই মনে করেন। কিন্তু যতক্ষণ না সাত নম্বর দেশকে পেড়ে ফেলা যাচ্ছে ততক্ষণ এই সমর্থন পেয়েও শ্রীনির কোনও লাভ নেই।
বৃহত্তর মতবাদ অবশ্য সমর্থন পেলেও ভবিষ্যৎ ভারতীয় ক্রিকেট-বিপর্যয়ের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। তাদের ধারণা শ্রীনিবাসনের বোর্ড সিঙ্গাপুরে জিতলে আরও বড় চোরাবালিতে পড়ে চরম হারবে। বছরখানেকের মধ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণটাই পুরো চলে যাবে।
ভারতীয় কর্তারা অবশ্য পরে কী হবে-টবে অত ভাবতে রাজি নন। দেশের ক্রিকেটে স্পনসরশিপ ও টিভি থেকে প্রাপ্য আয়ের শতকরা চল্লিশ ভাগ গত এক বছরে কমে গিয়েছে। যেন-তেন প্রকারেণ এই টাকাটা আইসিসি-র কোষাগার থেকে তাঁরা বার করতে চান। নইলে ঠাঁটবাট থাকবে না। যুক্তি আর ভদ্রতার এখন সময় নয়।
ভারতীয় বোর্ড কর্তারা না শোনে ধর্মের কাহিনি! |