শিল্প গড়তে জোর, নজরে নেই চিকিৎসা
পুরুলিয়ার শিল্পের মুখ রঘুনাথপুর। গত কয়েকবছর ধরে এমনটাই প্রচার করে আসছে বিগত বামফ্রন্ট সরকার থেকে বর্তমান তৃণমূল সরকার। কিন্তু সেই রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতাল তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। এমনটাই অভিযোগ এখানে চিকিৎসা করাতে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাওয়া রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের।
রঘুনাথপুর শহরকে ঘিরে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি কলকারখানা তৈরি হয়েছে। চলছে ডিভিসি-র মেগা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও। এ ছাড়া এনটিপিসি ও রেলের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র আদ্রায় হওয়ার কথা। রাজ্য সরকার এখানে শিল্পনগরী গড়ার কথাও ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই মহকুমার মানুষ তো বটেই, কলকারখানার শ্রমিকরাও চিকিৎসার জন্য এই রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালের উপরেই নির্ভরশীল। কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ সময়ে প্রথমে আহত শ্রমিক বা কর্মচারীদের আগে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু শ্রমিক সংগঠন থেকে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই হাসপাতালে কারখানায় দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। ফলে তাঁদের ভরসা আসানসোল বা বাঁকুড়ার হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোম। আর দূরত্বের কারণে সেখানে নিয়ে যেতে যেতেই আহতদের অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
গত এক-দেড় বছরে রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র নির্মীয়মান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে অন্তত পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আহত ঠিকা শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্য, দুর্ঘটনাগ্রস্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করে রঘুনাথপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জটিল অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। চিকিৎসকেরা পরিকাঠামো নেই জানিয়ে আহত শ্রমিকদের আসানসোল কিংবা বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করে দেন। ৬০-৭০ কিলোমিটার রাস্তার ধকল সামলাতে না পেরে শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটছে।
উদাহরণ হিসাবে সংগঠনগুলি সামনে আনছে, নিতুড়িয়ার কুলবনার বাসিন্দা ঠিকা শ্রমিক তারাপদ হাঁসদার মৃত্যুর ঘটনা। সম্প্রতি ডিভিসি-র প্রকল্পে কাজ করার সময় তিনি আহত হন। রঘুনাথপুর হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। জেলা সিটু নেতা তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ রায়ের অভিযোগ, “ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি দুঘর্র্টনাগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন এখানে তা নেই। অন্যত্র নিয়ে যেতে সময়ের অভাবে শ্রমিকদের বাঁচানো যাচ্ছে না।” তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র নেতা লালবাহাদুর সিংহের মতে, “রঘুনাথপুরকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। কাজেই কলকারখানায় যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, সে রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা আগে তৈরি করা দরকার।”
কী করেই বা জটিল অস্ত্রোপচার করা হবে? এই হাসপাতালে যে স্থায়ী কোনও শল্য চিকিৎসকই নেই! হাসপাতাল সূত্রে খবর, এই হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র একজন।.তিনি আবার অস্থায়ী ভাবে এখানে কাজ করছেন। সপ্তাহে মাত্র চার দিন তিনি রঘুনাথপুরে থাকেন। ফলে অন্য দিনগুলিতে শল্য চিকিৎসার মামুলি সমস্যায় নিয়ে এখানে রোগী এলেও তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তর করে দেওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের উপায় থাকে না। শল্য চিকিৎসকের পাশাপাশি অভাব রয়েছে শিশু বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিভাগ ও সাধারণ চিকিৎসকেরও। নেই পুরোদস্তুর ‘ব্লাড ব্যাঙ্ক’। হাসপাতাল সুপার শান্তনু সাহুর স্বীকারোক্তি, “নব্বুইয়ের দশকের পরিকাঠামো দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে। গত ২৫ বছরে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি বাড়লেও সে তুলনায় রোগীর চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি।”
ফলে শয্যা নিয়ে সমস্যা মেটেনি। সিজার রুমে শয্যা রয়েছে মোটে ৫টি। স্বাস্থ্যকর্মীরাই জানাচ্ছেন, ওই শয্যাগুলিতে রোগী ভর্তি থাকলে নতুন সিজার রোগীদের ভর্তির তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়। তেমন হলে কোনও প্রসূতিকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতেও হয়। প্রসূতিদের আত্মীয়দের অভিযোগ, সিজার করার পরে সিজার রুমে প্রসূতিদের রাখার নিয়ম। বাস্তবে অস্ত্রোপচারের পরে সাধারণ প্রসূতিদের সঙ্গেই রাখা হচ্ছে ওই প্রসূতিদের। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আবার আন্ত্রিকের মতো সংক্রমক রোগীদের রাখার ব্যবস্থা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে এখানে।
রোগীদের স্থানান্তর করা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সটি বহু পুরনো। মাঝেমধ্যেই বিকল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময় স্থানান্তর করা রোগীদের পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল কিংবা বাঁকুড়া মেডিক্যালে নিয়ে যেতে ভরসা বেশি ভাড়ার বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স। সমস্যা রয়েছে রোগ নিণর্র্য়ের ক্ষেত্রেও। নেই স্থায়ী প্যাথোলজিস্ট। রক্ত সংরক্ষণ কেন্দ্রে নেই স্থায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আলট্রা সোনোগ্রাফি বিভাগে প্রয়োজন দু’জন রেডিওলজিস্টের। রয়েছেন মাত্র একজন। ফলে আধুনিক মানের ইউএসজি মেশিন থাকলেও সপ্তাহে পাঁচ দিন বন্ধ থাকে ওই বিভাগ। ঘাটতি রয়েছে সিস্টার ইনচার্জ, স্টাফ নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, ওয়ার্ড মাস্টারের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি কিছু চিকিৎসক নিয়োগ হওয়ায় সমস্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও কর্মীর ঘাটতি বিশেষ মেটেনি। বর্তমানে কর্মী ঘাটতি রয়েছে কমবেশি ষাট জন।
পরিকাঠামোগত ঘাটতির মধ্যেই সাম্প্রতিক কালে এই হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান তুলনামূলক ভাবে বেড়েছে বলে মনে করে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কমিটি। দীর্ঘ দিন ধরে এই হাসপাতালের মানোন্নয়নের দাবিতে আন্দোলনকারী ওই সংগঠনের নেতা সোমনাথ কৈবর্ত্য বলেন, “আগে হাসপাতালে চিকিৎসকের ঘাটতি খুব বেশি পরিমাণে ছিল। সেই অভাব না মিটলেও বর্তমানে কিছু চিকিৎসক পাওয়া গিয়েছে।” তিনি জানান, এক সময় বন্ধ থাকা অর্থোপেডিক বিভাগ, ইএনটি এবং চক্ষু বিভাগে এখন পরিষেবা মিলছে।
বস্তুত নতুন সুপার আসার পরেই খুলেছে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা রক্ত সংরক্ষণ বিভাগ। সেখানে এখন বাইরে তালিকায় উল্লেখ থাকে কোন গ্রুপের রক্ত কত পরিমাণে রয়েছে। স্থানীয় বাবুগ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে একশো দিনের প্রকল্পে হাসপাতালের বাইরে দীর্ঘ সময় জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে। হাসপাতাল সুপারের কথায়, “পরিকাঠামোগত সমস্যার মধ্যেও পরিষেবা দিতে আমরা সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছি।”
পুরুলিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “রঘুনাথপুরে শিশু বিভাগের নবজাত শিশুদের পরিচর্চাকেন্দ্র (এসএনসিইউ) গড়ার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন মিলেছে। অর্থ দফতরের অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা চলছে।” তাঁর আশ্বাস, জরুরি বিভাগের উন্নয়নে দ্রুত কাজ শুরু হবে। কমবেশি ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালটিকে দ্বিতল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুরোদস্তুর ব্লাড ব্যাঙ্ক নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “চিকিৎসক ও কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রঘুনাথপুর হাসপাতালের উপরে বিশেষ নজর রয়েছে আমাদের।”
হাসপাতালের অসুখ
পদ ২টি, রয়েছেন একজন (অস্থায়ী)
পদ ১২টি, রয়েছেন ১০ (একজন অস্থায়ী)
পদ ১টি, বর্তমানে নেই
পদ ২টি, রয়েছেন ১
পদ ৩টি, কেউ নেই
পদ ১টি, এখন শূন্য
পদ ৩টি, রয়েছেন ১
পদ ৫০টি, রয়েছেন ২৮
পদ ৫০টি, রয়েছেন ২৯
পদ ২টি, রয়েছেন ১
পদ ৯টি, রয়েছেন ৩



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.