টিটাগড়ে লুমটেক্স চটকলের শ্রমিকদের রেল অবরোধ সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে শ্রমিকদের স্নায়ুর লড়াইয়ের চেহারা নিল। দিনভর অবরোধ সত্ত্বেও কোনও মন্ত্রী বা বিধায়ক এলেন না শ্রমিকদের কাছে। মিলল না কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিও। শেষ অবধি শ্রম কমিশনারের দফতর থেকে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েই অবরোধ তুলতে হল শ্রমিকদের। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ওই বৈঠকের দিন ধার্য হয়েছে। কিন্তু দাবি না মিটলে আবারও আন্দোলনে যাবে ১১টি শ্রমিক সংগঠনের মঞ্চ, এমনই হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।
সোমবারের রেল অবরোধ বড় রকম বিপর্যয়ের চেহারা নিয়েছিল। কলকাতায় আসতে না পেরে ফিরে গেলেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। যাতায়াতের পথে আটকে পড়েছিলেন নানা দলের তিন বিধায়কও। অগণিত অফিসযাত্রীও আসতে পারেননি। ফের আন্দোলন শুরু হলে আবারও জনজীবন বিপর্যস্ত হবে। কেন শ্রমিক অসন্তোষ এই চেহারা নিচ্ছে? |
টিটাগড় স্টেশনে শ্রমিকদের রেল অবরোধ। —ফাইল চিত্র। |
শ্রমিক ইউনিয়নগুলির যৌথ কমিটির দাবি, চটকল শ্রমিকদের বকেয়া প্রাপ্য মেটানোর ব্যাপারে চটকল মালিকরা উদাসীন। সরকারও শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে হস্তক্ষেপ করছে না। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় লেবার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, চালু চটকলগুলিতে শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইএসআই বাবদ সাড়ে চারশো কোটি টাকারও বেশি বাকি রয়েছে। বকেয়া টাকা না পাওয়ায় অবসরের পর ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। বছরের পর বছর অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ের লুমটেক্স চটকল এই বিপন্নতার অন্যতম উদাহরণ, বলছেন ইউনিয়ন নেতারা। তাঁরা হিসেবপত্রের কাগজ দেখিয়ে দাবি করছেন, শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বকেয়া ৪৪ কোটি টাকা, গ্র্যাচুইটি বাবদ ১৫ লক্ষ টাকা, আর ইএসআই বাবদ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। গত ১৫ বছর ধরে এই নিয়ে আন্দোলনও চলছে লাগাতার। শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেই মালিকপক্ষ বকেয়া মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু টাকা মেলে না। বকেয়া টাকার আশায় ২০০ টাকা রোজে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব শ্রমিকেরা। মারা গেলে সেই টাকা আদায় করতে বিপাকে পড়ে পরিবার।
শুধু লুমটেক্স নয়, গত ১৫-২০ বছর ধরে চটকল শ্রমিকদের আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে বকেয়া পিএফ-গ্র্যাচুইটির দাবি। লুমটেক্স জুটমিলে প্রায় চার হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৭০ শতাংশ শ্রমিকই অবসর নিয়েছেন। মাত্র ২০০ টাকা রোজে কাজ করছেন, যা তাঁদের আগের মজুরির অর্ধেক।
লুমটেক্স জুটমিলের এআইটিউসি নেতা টোলোন রাম দীর্ঘ দিন ওই চটকলে কাজ করেছেন। তাঁর দাবি, ২০০৯ সালে লুমটেক্স-এর মালিকপক্ষ বারবার শ্রমিকদের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও মাত্র ৩০০ শ্রমিক এখনও পর্যন্ত পিএফ-গ্র্যাচুইটি পেয়েছেন। টাকা বাকি রয়েছে বলে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের বাসিন্দারা বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
কেন প্রাপ্য পাচ্ছেন না লুমটেক্সের শ্রমিকরা? শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জুট মিলের বেশির ভাগ শ্রমিকদেরই পিএফ-গ্র্যাচুইটি বাকি রয়েছে। লুমটেক্সের মালিককেই কেন একেবারে সব টাকা মিটিয়ে দিতে হবে?”
মন্ত্রীর যুক্তিতে বিস্মিত আন্দোলনকারীরা। তাঁদের আন্দোলনের অন্যতম নেতা শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর প্রশ্ন, “একজন আইন ফাঁকি দিলে কি সেই যুক্তিতে অন্যদের বেআইনি কাজ করার অধিকার জন্মায়?” তাঁর দাবি, দীর্ঘ দিন ধরে আইনি পথেই শ্রমিকদের প্রাপ্য নিয়ে আন্দোলন চলছে। চিঠি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দফতরে। মন্ত্রী এগুলোকে উপেক্ষা করছেন। শ্রমমন্ত্রীর পাল্টা দাবি, গত বছর ৭ মে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে ওই ১১টি শ্রমিক ইউনিয়ন আসেনি। বরং পরিকল্পনা করে মিলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে তারা। “চটকল কর্তৃপক্ষ কি ক্ষতি করতে মিল চালাবেন?” প্রশ্ন করেন তিনি।
লুমটেক্স চটকলের সমস্যা আরও জটিল হয়েছে দুটি কারণে। একদিকে কারখানার মালিকানা ছয় জনের। তাদের মধ্যে কারা প্রকৃত মালিক তা প্রমাণ নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। মালিকদের এক একজন শ্রমিকদের এক এক রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। অন্যদিকে, অনেকগুলি শ্রমিক সংগঠন থাকায় কখন কে গিয়ে বৈঠকে বসবে, চুক্তি সই করবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বারবার। সম্প্রতি শ্রমিকদের চাপে সবক’টি সংগঠন এক মঞ্চে এসেছিল বলে সম্মিলিত আন্দোলন করা সম্ভব হয়েছে। এর পর পরিস্থিতি কী হয়, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। সারাদিনের রেল অবরোধও শ্রমিকদের জীবনে গতি আনবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। |