রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা (টেট) উত্তীর্ণদের মধ্যে কত জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং কত জনের প্রশিক্ষণ ছিল না সেই তথ্য তাঁর কাছে নেই। পাঁচ পর্যায়ে কাউন্সেলিংয়ের পরে কত প্রাথমিক শিক্ষক নিযুক্ত হলেন, তা-ও জানা নেই। কিন্তু বামফ্রন্টের কোন দলের নেতার কোন আত্মীয় কবে প্রাথমিক শিক্ষক হয়েছেন, সেই তালিকা তাঁর কাছে আছে। টেট-এ শাসক দলের স্বজনপোষণ সংক্রান্ত অভিযোগের পাল্টা হিসেবে ওই তালিকাকেই হাতিয়ার করলেন রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য।
বুধবার পর্ষদের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন মানিকবাবু। তবে এ বারের টেটের জরুরি তথ্যগুলি পেশ না করে তিনি কেন কাগজ খুলে বাম আমলে চাকরি পাওয়া ফ্রন্ট নেতাদের আত্মীয়দের নাম উল্লেখ করলেন তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেতে শুরু করেছে। মানিকবাবু অবশ্য মনে করেন, ওই তালিকা প্রকাশ করে তিনি ভুল করেননি।
তাঁর দাবি, “ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ক্রমাগত আক্রমণ করলে জবাব তো দিতেই হবে!”
গত বছর টেট পরীক্ষা হয়েছিল ৩১ মার্চ। অভিযোগ, শাসক দলের নেতানেত্রীরা নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন ঘনিষ্ঠদের। কালনার তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর পরিবারের ছ’জন টেট-এ কৃতকার্য হওয়ায় প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূলেরই কেউ কেউ। এ সবের প্রতিবাদে মঙ্গলবার পর্ষদের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখান এক দল প্রার্থী।
মানিকবাবু এ দিন বলেন, “অভিযোগের কথা আমার কানেও এসেছে। হুগলিতে একই পরিবারের তিন জন টেট-এ কৃতকার্য হয়েছেন। তাঁরা সকলেই সিপিএমের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির পুত্র, পুত্রবধূ ও মেয়ে।” এর পরেই দীর্ঘ তালিকা দিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিএম-সহ বিভিন্ন বাম দলের নেতার কোন কোন আত্মীয় টেট-এ সফল হয়েছেন। এঁদের অনেকে আবার বাম আমলেও চাকরি পেয়েছেন। মানিকবাবুর কথায়, “একটি দলের নেতার আত্মীয়েরা চাকরি পেলে যদি অভিযোগ ওঠে, তা হলে অন্য দলের নেতার পরিবার পেলে তা নিয়ে অভিযোগ উঠবে না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।”
শিক্ষক নিয়োগের আগে পর্ষদ-সভাপতি তৃণমূলের দুই নেতা মুকুল রায় ও সুব্রত বক্সির বৈঠক করেছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। মানিকবাবুর সাফ জবাব, “আমি সুব্রত বক্সি বা মুকুল রায়দের চিনি না। আমার কাজ রাজ্যের শিশুদের কাছে শিক্ষক পৌঁছে দেওয়া আর যোগ্য প্রার্থীদের চাকরির সুপারিশ করা। সেই কাজ সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়েছে। স্বজনপোষণের অভিযোগ পুরোপুরি ভুল।” তাঁর পাল্টা চ্যালেঞ্জ, এক জন যোগ্য প্রার্থীও চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে শিক্ষাজগতে আর মুখই দেখাবেন না তিনি। প্রসঙ্গত পর্ষদ-সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি মানিক ভট্টাচার্য আবার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজের অধ্যক্ষও।
চলতি মাসের গোড়ায় এক সাংবাদিক বৈঠক করে মানিকবাবু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত সমস্ত প্রার্থীকে জানুয়ারির মধ্যে চাকরি দেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতি তাঁরা পালন করেছেন বলে এ দিন দাবি করেন তিনি। পরবর্তী টেট হবে ৩০ মার্চ। কিন্তু কত শূন্য পদের জন্য পরীক্ষা হবে, সেই তথ্য দিতে পারেনি পর্ষদ। আদালতের নির্দেশেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের আলাদা তালিকা তৈরি করার কথা পর্ষদের। সেই তালিকা তৈরি হয়েছে বলেও দাবি মানিকবাবুর। তা হলে কেন ওই দুই ধরনের প্রার্থীর হিসেব তাঁর কাছে নেই, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি সভাপতি। বস্তুত, সাংবাদিকদের বেশ কিছু প্রশ্ন এ দিন এড়িয়ে, সম্মেলন ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি। টেট-কাণ্ড নিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা সুপ্রিম কোর্টে যে দুটি মামলা করেছেন তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীনদের পৃথক তালিকা তৈরির নির্দেশিকা মানা হয়নি। সেই আবেদন গ্রহণও করেছে শীর্ষ আদালত। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাব দিতে চাননি মানিকবাবু।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি সাংবাদিক বৈঠক করে যা-ই বলুন না কেন, টেট নিয়ে বিতর্ক-বিক্ষোভ কিন্তু এড়ানো যায়নি আজও। টেট-এ স্বজনপোষণের প্রতিবাদে এ দিন কলেজ স্ট্রিটে সভা করে ছাত্র পরিষদ। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অভিযোগ করেছেন, “প্রাথমিকে মোট শূন্য পদের অর্ধেকও পূরণ করা যায়নি। মোট পরীক্ষার্থীদের মাত্র ১ শতাংশের বেশি কেউ যোগ্যতামান পেরোননি বলে জানানো হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই চাকরি পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা শাসক দলের নেতা-বিধায়কদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাা!” বামেদের ছাত্র যুবদের মতোই সূর্যবাবুও ফের ওই পরীক্ষা আয়োজনের দাবি করেছেন। এত অভিযোগের পরেও সরকার কেন তদন্ত করাতে রাজি হচ্ছে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। তৃণমূল ছেড়ে সদ্য কংগ্রেসে যোগ দেওয়া সোমেন মিত্রের গলাতেও অভিযোগের এক সুর। এ দিন কলকাতা পুরসভার মজদুর পঞ্চায়েত কংগ্রেসের এক সভায় তিনি বলেন, “দেখা যাচ্ছে টেট-এ উত্তীর্ণ অধিকাংশই তৃণমূলের বিধায়ক, নেতাদের পরিবারের লোক।”
তবে বিরোধীদের এই সব অভিযোগে আমল দিতে রাজি নন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর কথায়, “কিছু শিল্পপতি বিশ্বাস করেন, সিপিএম ক্ষমতায় ফিরলে তাঁদের সুবিধা হবে। এই শিল্পপতিদের সংবাদমাধ্যম টেপ বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশন করছে, নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে। তাঁদের এই চেষ্টা সফল হবে না।”
|