লোকসভা নির্বাচন আসিতেছে। কংগ্রেস ফের জিতিবে, এমন দুরাশা সম্ভবত দশ জনপথেও নাই। তবুও, ভারতীয় রাজনীতিতে দলটি এখনও গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনের পরেও থাকিবে। সেই দলের শীর্ষ নেতা, এবং অঘোষিত হইলেও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রাহুল গাঁধীও, তাঁহার দলীয় পরিচয়ের সুবাদেই, গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন বহু বৎসর। কিন্তু, তাঁহাকে চিনিবার যথেষ্ট সুযোগ দেশবাসী পায় নাই। তিনিই সেই সুযোগ দেন নাই। এখনও পর্যন্ত রাহুল গাঁধীর অভিজ্ঞান তাঁহার আকস্মিকতা। তিনি কোন মঞ্চে, কখন কোন কথা বলিবেন, তাহা প্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-তুল্য, অন্তত অনিশ্চয়তার মাপকাঠিতে। এহেন রাহুল গাঁধী প্রথম বার একটি ‘সর্বভারতীয়’ টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিলেন। এমন একটি সময়ে, যখন ভারত বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। কোন সমস্যাটিকে রাহুল কী ভাবে দেখেন, কোন পথে সমাধানের কথা ভাবেন, জানিতে অনেকেরই আগ্রহ ছিল। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শতাধিক প্রশ্ন করা হইল, তেরো হাজারেরও অধিক শব্দ উচ্চারিত হইল, কিন্তু রাহুলের মনটি যেমন অজ্ঞাত ছিল, ঠিক তেমনটিই থাকিল। প্রায় আড়াই বৎসর পূর্বে চাণক্য এক ধরনের মানুষ সম্বন্ধে বলিয়াছেন, তাঁহারা সভায় যত ক্ষণ কথা না বলেন, তত ক্ষণই শোভন সজ্জায় শোভিত হইয়া শোভা পান। টেলিভিশনের পর্দায় রাহুল গাঁধীর প্রথম সাক্ষাৎকার আরও এক বার বলিয়া দিল, চাণক্যের প্রজ্ঞা কেন কালজয়ী।
রাহুল গাঁধী ব্যক্তিমাত্র নহেন, তিনি আপাতত কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ। অতএব, তিনি সভামধ্যে নীরব বসিয়া থাকিলে ভারতের চলিবে না। এক বৎসরের অধিক হইল তিনি কংগ্রেসের সহসভাপতি হইয়াছেন। এই এক বৎসরে তাঁহার আকস্মিক বচনামৃত কিছু ক্ষেত্রে নির্মল হাস্যরস জোগাইয়াছে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও অর্থ বহন করিতে পারে নাই। অথচ, তাঁহার ক্ষমতা কম নহে। তাঁহার আবেগের উচ্ছ্বাসে সরকারের অর্ডিন্যান্স ভাসিয়া যাইতে পারে, তাঁহার একটি কথায় এলপিজি-র ভর্তুকি ৩৩ শতাংশ বাড়িয়া যায়। বস্তুত, মনমোহন সিংহ যে এই সরকারের অঙ্গসজ্জা বই কিছু নহেন, এই একটি কথাই রাহুল প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন। কিন্তু, তাহাতে তাঁহার দায়বৃদ্ধি হয়, কারণ দলের এবং সরকারের নীতি স্থির করিবার দায়িত্ব তাঁহার উপরেই বর্তায়। আলোচ্য সাক্ষাৎকারে রাহুল বুঝাইয়া দিয়াছেন, সেই সব কথা তাঁহার নিকট শিশি-বোতলের ন্যায় শক্ত ঠেকে, এবং সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা যে আছে, তাহা ‘সেন্স’ করিতে তাঁহাকে কেরল যাইতে হইয়াছিল, এই সত্য বাস্তবিকই মর্মস্পর্শী। নির্মাণশিল্পে ভারতকে চিনের তুল্য করিবার অভ্রংলিহ উচ্চাশাটি কোন মন্ত্রে বাস্তবায়িত হইবে, রাহুল বলেন নাই। অনুমান, জানেন না বলিয়াই বলেন নাই। এই বিপুল অজ্ঞানতার ভার কংগ্রেস এবং ভারত কী ভাবে বহন করিবে?
রাহুল তাঁহার ৮০ মিনিটে বহু বার ‘মূল প্রশ্ন’-এ ফিরিয়া যাইবার কথা বলিয়াছেন। অতি উত্তম বাসনা, তবে একটিই সমস্যা— মূল প্রশ্নটি যে কী, তাহা তিনি জানেন বলিয়া এক বারও বোধ হয় নাই। দেখা গেল, তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, ব্যবস্থার পরিবর্তন (কোন ব্যবস্থা?) ইত্যাদি শ্রুতিমধুর এবং মূলত অন্তঃসারশূন্য কথা বলিতেই অধিক স্বচ্ছন্দ। গত দশ বৎসরে কংগ্রেস নেতারা, এবং অবশ্যই সনিয়া গাঁধীর জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ এমন কথা বহু বার বলিয়াছে। এই মুহূর্তে ভারতের আরও এক জন তাত্ত্বিকের প্রয়োজন নাই। দরকার এমন এক নেতার, যিনি নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, এবং সেই কর্তব্য সম্পাদনে সমর্থ। রাহুল যে সেই নেতা নহেন, তাহা এই সাক্ষাৎকারের পর প্রশ্নাতীত। তেমন কোনও নেতা আছেন কি না, আগামী কয়েক মাস সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান জারি থাকিবে। |