জেলার প্রকাশক
মাটির কাছাকাছি
অঞ্চল চর্চায় চিরকালই ভূমিপুত্ররা প্রথম সারিতে। কিন্তু প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হলেও ইতিহাস-সংস্কৃতির বই প্রকাশ করতে গেলে কলকাতার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া অধিকাংশ সময়েই উপায় ছিল না। কিছু দিন আগেও শহরের বড় প্রকাশকরা জেলার খুঁটিনাটি ইতিহাসের কথা প্রকাশ করতে খুব আগ্রহী হতেন না। কয়েক বছর হল পরিস্থিতি বদলেছে। এক দিকে যেমন কলকাতার প্রকাশকরা জেলার সংস্কৃতি নিয়ে বই প্রকাশে কিছুটা উৎসাহ দেখাচ্ছেন, অন্য দিকে জেলাস্তরেও উঠে আসছে নবীন প্রকাশনা-সংস্থা, যারা নিজের বা অন্যান্য জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এদের উৎসাহে, আর ক্ষেত্রসমীক্ষকদের পরিশ্রমে বাংলার অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাস ও লোকায়ত সংস্কৃতির এমন অনেক উপাদান হাতের নাগালে চলে আসছে, যা সত্যিই অভাবনীয়।

সিউড়ি (বীরভূম)-এর ‘রাঢ়’ প্রকাশনা যেমন সিউড়ি-র বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব শিবরতন মিত্রের দুর্লভ রূপকথা সংকলন সাঁজের কথা (১৯১৯) নতুন করে প্রকাশ করেছে, তেমনই হাতের কাছে এনে দিয়েছে প্রবীণ গবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেন-এর পশ্চিমবঙ্গ গীতিকা (১ম খণ্ড)। দীনেশচন্দ্র সেনের পূর্ববঙ্গ গীতিকা সুপরিচিত, পশ্চিমবঙ্গেও যে গীতিকা-র বিপুল বৈচিত্র আছে তা এখানে ধরা পড়েছে। ১৩০৪ বঙ্গাব্দে বাংলায় প্রথম রূপকথা সংকলন করেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, তাঁর লোক সাহিত্য সংগ্রহ (সম্পা: মনোজ মন্ডল) বইটিও ‘রাঢ়’-এর বিশেষ প্রকাশনা। এ ছাড়া পুরুলিয়ার লোককাহিনি সংগ্রহ করেছেন সুভাষ রায়। প্রস্তুতি চলছে ‘রাঢ়কথা’ পত্রিকার ‘সত্যপির’ সংখ্যারও।

অন্য দিকে বিষ্ণুপুরের (বাঁকুড়া) ‘টেরাকোটা’ প্রকাশনা ‘টেরাকোটা’ নামে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতির একটি সচিত্র পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশনার পাশাপাশি ছোট ছোট বইয়ে ধরে রাখতে চাইছে বাংলার ইতিহাস-শিল্প-সংস্কৃতি। ত্রিপুরা বসুর পুথির কথা, অঞ্জন সেন-র বাংলার মধ্যযুগের চিত্রকলা, দীপঙ্কর ঘোষের পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চ-র মতো বেশ কয়েকটি বই ইতিমধ্যেই প্রকাশিত। বাঁকুড়ার সব থেকে পুরনো পত্রিকা বাঁকুড়া লক্ষ্মী-র সংকলন বা ডেভিড ম্যাককাচ্চনের দ্য টেম্পল্স অব বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট-এর মতো দুর্লভ বই প্রকাশেও তারা উদ্যোগী, এমন সংবাদ নিশ্চিতই আশা জোগায়। অঞ্চল চর্চায় উৎসাহীরাও জোর পাবেন, সন্দেহ নেই। ডান দিকের ছবি দু’টি বিষ্ণুপুরের ‘টেরাকোটা’ পত্রিকায় প্রকাশিত বর্ধমানের অম্বিকা কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরের।

বিস্মৃত কে
তাঁর কণ্ঠে ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার’ শুনে সুর নিয়ে আপত্তি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুর বদলে কবি তাঁকে ফের রেকর্ড করতে বললেও রাজি হননি। নজরুলের সঙ্গে কিন্তু ছিল তাঁর সখ্য। ১৯১২-য় তাঁরই করা রেকর্ডে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ ছড়িয়ে পড়েছিল মাঠেঘাটে। নজরুল যখন একের পর এক শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, আগমনী গান এবং শ্যামাসঙ্গীত গেয়েই খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছে গিয়েছেন মুনশি মহম্মদ কাশেম। তবে স্বনামে নয়, কে. মল্লিক নামে। আসল নাম বা মানু মিঞা নামে তাঁকে চিনতেন শুধু ইসলামি গানের শ্রোতারা। আবাসউদ্দিনের সঙ্গে তিনি রেকর্ড করছেন কাশেম নামে, আবার কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে একই রেকর্ডে ‘ও নিঠুর কালাচাঁদ’ গাইছেন ছদ্মনামে। জন্ম ১৮৮৮ সালে, বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার কুসুমগ্রামে। তিরিশের দশক পর্যন্ত বহু গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৬১-তে প্রয়াত গায়ককে নিয়ে বিস্মৃত সুরশিল্পী কে. মল্লিক নামে একটি বই আগেই প্রকাশ হয়েছিল। সম্প্রতি বর্ধমান-নিবাসী গিরিধারী সরকার বিস্মৃতির সংগীতশিল্পী কে. মল্লিক নামে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। আবেগের আতিশয্য সত্ত্বেও ধরতাইটা ধরিয়ে দেওয়ার মতো অনেক তথ্যই সেখানে মজুত আছে।

অনুত্তমের রবি
এ পথের শেষ কোথায়? জানেন না অনুত্তম ভট্টাচার্য। তাঁর সাধের সাধনা একটিই রবীন্দ্ররচনার অভিধান। স্বভাবত সে কেবল একটি বই নয়। সম্পূর্ণ একার চেষ্টায় এখনও পর্যন্ত চোদ্দোটি খণ্ড তৈরি করেছেন তিনি। প্রকাশ করেছে দীপ প্রকাশন। কেমন সেই অভিধান? ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’। কবিতাটি বিশ্বভারতীর রচনাবলির কোন সংস্করণের কোন খণ্ডের কত পৃষ্ঠায় আছে, তার ছত্রসংখ্যা কত, স্তবক ক’টি, রচনার স্থান-কাল, নামকরণের ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের করা ইংরেজি অনুবাদের বিবরণ, কবিতার নানা সমালোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ সব একত্রে সাজানো। শুধু কবিতাই নয়, চিঠিপত্র বাদে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা নিয়েই গত প্রায় দু’দশক ধরে একা কাজ করে চলেছেন অনুত্তমবাবু। সেটাও কলকাতায় নয়, শান্তিনিকেতনে নয়, মেদিনীপুরে বসে। কাজ শেষ। কলকাতা বইমেলায় ১৫ ও ১৬ নম্বর খণ্ড প্রকাশিত হচ্ছে।

সিরাজের খোঁজে়
নিজের খোশবাসপুর গ্রাম, পরিবার আর ধর্মচিন্তা ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কান্দি মহকুমার যে বিস্তীর্ণ নিচু জমি বর্ষায় জলডুবি হয়, সেই ‘হিজল’ এলাকার প্রান্তে খোশবাসপুর। তারই ভূপ্রকৃতি ধরা দিয়েছে সিরাজের ‘হিজলকন্যা’-য়। ‘মায়ামৃদঙ্গ’-এ তিনি এঁকেছেন আলকাপ সম্রাট, জঙ্গিপুরের ঝাঁকসুকে। বারবারই মুর্শিদাবাদ ঘুরে-ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। বাদ যায়নি ছোটগল্প ‘গোঘ্ন’ অথবা ‘রানিরঘাটের বৃত্তান্ত’ (এই গল্প নিয়েই তৈরি বাংলা ছবি ‘ফালতু’)। লালগোলায় ‘রফিকুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতা’য় এই সব প্রসঙ্গই তুলে আনলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক উৎপল ঝা। গল্পকার নীহারুল ইসলাম সম্পাদিত ‘খোঁজ’ পত্রিকার আয়োজনে ওই বক্তৃতার বিষয়ই ছিল ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাহিত্যে মুর্শিদাবাদ’। সাইলকের বাণিজ্য বিস্তার উপন্যাসের জন্য শাহযাদ ফিরদাউসকে সম্মানিত করা হয়।

সাঁতুড়ির কথা
পথই বেঁধে দিয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, শিক্ষকতার সঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার। তার ফসল মাধবচন্দ্র মণ্ডলের সাঁতুড়ির পুরাতত্ত্ব ও মেলা। কবে পায়ে হেঁটে গ্রামে ঘুরে পুরুলিয়ার ইতিহাস লিখেছিলেন বেগলার সাহেব। পরে এইচ কুপল্যান্ড মানভূম গ্রন্থে দেন প্রত্নস্থলের সবিস্তার নির্দেশিকা। আর বাঘমুণ্ডির গ্রামের স্কুলের শিক্ষক মাধব লিখেছেন নিজের ব্লক, বাঁকুড়ার সাঁতুড়ির ইতিহাস। প্রত্নস্থল ও মেলাগুলির বিবরণ নিয়ে আগেই প্রকাশিত বইটি আরও তথ্য ও ছবিতে ভরছেন মাধব।

কপিলা ও সত্যপির
কপিলামঙ্গল পুথির খোঁজে পুরুলিয়ার বোরোয় তামাখুন গ্রামে হানা দিয়েছিলেন বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের বাংলার অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়। কপিলাগাইয়ের বন্দনা নিয়ে এই প্রাচীন মঙ্গলকাব্য রাঢ় বাংলায় আজও প্রচলিত। কপিলামঙ্গল নিয়ে আলোচনা প্রথম করেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ পালিত, ১৯৪৯ সালে বাঁকুড়া থেকে প্রকাশিত ‘ফাল্গুনী’ পত্রিকায়। অরবিন্দের দ্বিজ কবিচন্দ্রের কপিলামঙ্গল এবং ফকিররামের সত্যপিরের পাঁচালি বের করেছে বিষ্ণুপুরের ‘টেরাকোটা’ প্রকাশন।


তাস থেকে ঢোকরা
বিদ্যুৎ ফৌজদারের আঁকা দশটি তাসের ছবি এবং এই লুপ্তপ্রায় লোকশিল্প নিয়ে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় এবং বিনয় ঘোষের তিনটি লেখার সংকলন দশাবতার তাস (সম্পাদনা শর্মিষ্ঠা দত্ত) দিয়ে বছর দুই আগে সূচনা হয়েছিল প্রতিক্ষণ লোকশিল্প গ্রন্থমালার। উদ্দেশ্য, দেশের বিভিন্ন লোকশিল্প নিয়ে ‘হ্যান্ডবুক’ তৈরি করা। এই সিরিজে তার পরে প্রকাশিত হয়েছে মিতা চক্রবর্তীর বাংলার মুখোশ এবং নীলাঞ্জনা ঘোষের বাংলার কাঁথা। বেরোতে চলেছে এ রাজ্যের বিকনা, দরিয়াপুর এবং মধ্যপ্রদেশের বস্তারের ঢোকরা নিয়ে লেখা ও ছবির সংকলন ঢোকরা শিল্প। সঙ্গের ছবিটি দশাবতার তাসের।

জীবনের জন্য
‘তোমার মনের গভীরে যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাই তোমাকে চিনিয়ে দেয়’... উপনিষদ থেকে টমাস হবস বইয়ের পাঠ আর নিজের জীবনের পাঠ দিয়ে আত্মশক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বর্তমানে বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। তাঁর লাইফ লিঙ্গুয়া (কথাচিত্র প্রকাশন) নামে বইটির কিশোর সাহা-কৃত বাংলা অনুবাদ জীবনের ভাষা প্রকাশিত হল বইমেলার উদ্বোধনের দিন। মঞ্চেই ইংরেজি ও বাংলা বই দু’টির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


একাই প্রবাদে
‘ভবিতব্যং ভবতেব্য খণ্ডিতে কে পারে।/ বৃদ্ধকালে হরিহোড় বিয়া কৈল তারে।’ কিংবা ‘জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ।’... বাংলার প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে আগেও নানা সংকলন হয়েছে। সম্প্রতি একক উদ্যোগে বাংলা ভাষার প্রবাদ নামে সংকলন করেছেন রাজ্য মৎস্য দফতরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক, সিউড়ির বাসিন্দা সমীরকুমার অধিকারী। এর আগে তিনি বাংলার হাফুগান-এর মতো সংকলন করেছেন।

কালি-কলম-ক্যামেরা
১৯৫৬ সালে উদ্বাস্তুদের জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে উল্টোরথ পত্রিকায় বেরিয়েছিল চেনামুখ নামে একটি বড়গল্প। চার বছর বাদে সেই কাহিনীই হয়ে উঠল ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা। ছবি মুক্তির পরেই লেখক চলে আসেন আলোচনার বৃত্তে। লেখক শক্তিপদ রাজগুরু আনকোরা নন। ১৯৪২-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প আবর্তন। ১৯৪৫-এ প্রথম উপন্যাস দিনগুলি মোর। দীর্ঘ লেখক জীবনে প্রকাশিত হয়েছে তিন শতাধিক বই। চলচ্চিত্রায়িত ৩১টি। ১৯৭৫ সালে তাঁর নয়া বসত গল্প থেকে শক্তি সামন্ত তৈরি করেন অমানুষ। বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই। ছ’বছর বাদে সেই শক্তি-জুটিই উপহার দেন অনুসন্ধান, হিন্দি সংস্করণে যা বরসাত কি এক রাত। লেখক এখন থাকেন কলকাতার সিঁথিতে। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার নাম হয়েছে শক্তিপদ রাজগুরু সরণি। কিন্তু আদতে তিনি বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র। ১৯২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বড়জোড়ার গোপবান্দি গ্রামে তাঁর জন্ম। পড়াশোনা মুর্শিদাবাদে পাঁচথুপি টি এন ইনস্টিটিউশনাল স্কুলে। সম্প্রতি বাঁকুড়া বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে শক্তিপদ রাজগুরু: স্রষ্টা ও সৃষ্টি। তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, বুদ্ধদেব গুহর মতো লেখকেরা। সংকলক নিতাই নাগ দিয়েছেন বিশদ তথ্যপঞ্জীও। আর দু’দিন বাদেই, শনিবার ৯২ পার করে ৯৩ বছরে পা দিচ্ছেন প্রবীণ কথাকার।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.