ধোঁয়া ওঠা ধবধবে সাদা ভাত। মনমাতানো সুবাসেই অর্ধেক পেট ভর্তি! তারই ভিতরে যে কালান্তক বিপদ লুকিয়ে আছে, কে জানত!
ফলন বিস্তর। তাই চাষিদের কাছে ওদের তুঙ্গ চাহিদা। আবার স্বাদে-গড়নে দুর্দান্ত। সরু সরু, লম্বা চাল। ফলে গেরস্তের ঘরেও মারকাটারি কদর। অথচ ললাট, আইআর-৩৬, আইআর-৬৪, মিনিকিট বা শতাব্দী-র মতো এই সব জনপ্রিয় চালেই ধরা পড়েছে এক দুরন্ত ব্যাধি। খাদ্যশৃঙ্খল বেয়ে যা কিনা অঞ্চল নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ছে এ রাজ্যের মানুষ ও গবাদি পশুর মধ্যে!
ব্যাধির নাম আর্সেনিক দূষণ। এবং বাঙালির প্রধান খাদ্যই পশ্চিমবঙ্গে তার অন্যতম বাহক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি দফতরের সমীক্ষায় প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গে খরিফ-রবি মরসুম মিলিয়ে গড়ে যত ধান উৎপাদিত হয়, তার অন্তত ৩০% আর্সেনিক-দূষণে দুষ্ট। বিপজ্জনক ধানগুলি ফলছে মূলত আর্সেনিক-অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও দুই ২৪ পরগনায়। সরকারি খাতায় বর্ধমানের পূর্বস্থলী-১, ২ নম্বর ব্লকও আর্সেনিক-অধ্যুষিত হিসেবে মার্কা মারা। তাই সে তল্লাটের ধানও নিরাপদ নয় বলে কৃষি-কর্তাদের দাবি।
কৃষি দফতরের খবর, আর্সেনিক প্রবণ অঞ্চলের আশি ভাগ জমিতে ললাট, আইআর-৩৬, আইআর-৬৪, মিনিকিট বা শতাব্দীর মতো জনপ্রিয় ধানের চাষ হয়। ওই সব ধানগাছ মাটির রস ও সেচের জন্য ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ জল দু’টি উৎস থেকেই খুব বেশি পরিমাণে আর্সেনিক টেনে নেয়। শোষিত আর্সেনিক জমা হয় গাছের কাণ্ড, পাতা ও দানা, অর্থাৎ চালের ভিতরে। এতে ধানগাছের আকৃতিগত কোনও পরিবর্তন হয় না। দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে, তারা বিষে বিষে জর্জরিত হয়ে গিয়েছে! |
কৃষি দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আর্সেনিক কবলিত পাঁচ জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির ‘জনপ্রিয়’ ধানের চালে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের অস্তিত্ব রয়েছে। কেজিপিছু চালে ৪০০ থেকে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত! এর কতটা মানুষজনের শরীরে ঢুকছে?
বিশেষজ্ঞদের হিসেবে, এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে দু’বার ভাত খেতে গড়ে চারশো গ্রাম চাল প্রয়োজন। যদি কেজিপিছু চালে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকে, তা হলে দু’বেলার ভাত মারফত তার দেহে রোজ দু’শো মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক প্রবেশ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হুঁশিয়ারি: ষাট কেজি ওজনের এক জন মানুষের দেহে দৈনিক বড় জোর ১২৬ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক ঢুকতে দেওয়া যেতে পারে। বেশি হলেই বিপদ!
অর্থাৎ, বিপদসীমা পেরিয়ে গিয়েছে। বিপদের পরিধিকেও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। কারণ, আর্সেনিকদুষ্ট ধান ফলছে যেখানে, সেখানকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষও পড়ছে আর্সেনিক-দূষণের গ্রাসে। “চাষিরা ধান বেচছেন চালকলে। মিল থেকে রাজ্যের আনাচে-কানাচে দূষিত চাল ছড়িয়ে পড়ছে। কোন চাল নিরাপদ, সেটা আলাদা করা যাচ্ছে না। কাজেই বিপদটা গোটা রাজ্যের।” মন্তব্য রাজ্য কৃষি দফতরের এক বিজ্ঞানীর। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সরোজ সান্যালের কথায়, “নলকূপ অন্যত্র হেঁটে চলে যেতে পারবে না। তাই আর্সেনিকদুষ্ট টিউবওয়েলের জল না-খেলেই হল। কিন্তু চালের বেলায় এ দাওয়াই খাটে না। চালে আর্সেনিক ঢুকে গেলে তা ভৌগোলিক বেড়া মানবে না।”
পরিত্রাণের উপায় কী?
বিশেষজ্ঞ ও কৃষকেরা তাকিয়ে রয়েছেন রাজ্য কৃষি দফতরের ধান গবেষণাকেন্দ্রের দিকে। চুঁচুড়ার ওই ল্যাবে তৈরি হওয়া নতুন এক ধানবীজ সমস্যার সুরাহায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে তাঁদের আশা। দফতর-সূত্রের দাবি, জমি বা জলের আর্সেনিক বর্জন করে এটি তরতরিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। চূড়ান্ত আর্সেনিক-প্রবণ এলাকায় চাষ করেও এর প্রতি কেজি চালে আর্সেনিক মিলেছে সর্বাধিক ৩৮ মাইক্রোগ্রাম। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি নতুন ধানের নামকরণও করেছেন। মুক্তশ্রী।
আর্সেনিকের থাবা এড়াতে আপাতত তাই ‘মুক্তশ্রী’ই ভরসা। চুঁচুড়া ধান গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানী বিজন অধিকারী জানান, আর্সেনিক-অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কিছু কৃষককে পরীক্ষামূলক ভাবে মুক্তশ্রীর বীজ দেওয়া হয়েছিল। ভাল ফল মিলেছে। পরীক্ষামূলক চাষের জন্য নতুন ধানবীজ পেয়েছিলেন যাঁরা, উত্তর ২৪ পরগনার কাউগাছির সেই সমীর মণ্ডল কিংবা পূর্বস্থলী-১ নম্বরের সোনারুদ্র গ্রামের রাজীব ভৌমিকেরাও ফলন দেখে সন্তুষ্ট। “আর্সেনিকের ভয় তো নেই-ই, তার উপরে চালটা সুগন্ধী, দেখতে সুন্দর। সরু, সম্বা। অনেকটা বাসমতীর মতো। ভাল চাহিদা থাকবে।” বলছেন ওঁরা। ফলনও যথেষ্ট বলে জানিয়েছেন সমীরবাবু-রাজীবাবুরা। “বোরোয় মিনিকিট চাষ করে বিঘেপিছু পাঁচশো কেজি ধান আসে। মুক্তশ্রী দিচ্ছে আটশো কেজির বেশি।” দাবি ওঁদের।
সুরাহার চাল তা হলে পুরোমাত্রায় চালু হবে কবে?
রাজ্য কৃষি দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (ধান উন্নয়ন) কমল ভদ্র বলেন, “রাজ্য সরকার ছাড়পত্র দিলেই বীজ হিসেবে এই ধান সরকারি ভাবে বাজারে আসবে।” দফতরের খবর, চুঁচুড়া ধান গবেষণাকেন্দ্রে এখন পাঁচ কুইন্টাল ‘মুক্তশ্রী’র বীজ মজুত আছে। রাজ্যের ছাড়পত্র এলে তা চাষ করে প্রথম বছরে শ’পাঁচেক কুইন্টাল বীজ পাওয়া যাবে। এ ভাবে দফায় দফায় ‘মুক্তশ্রী’র ব্যাপ্তি বাড়িয়েই বঙ্গবাসীর অন্নে আর্সেনিকের আগ্রাসন রোখার আশায় রয়েছেন কৃষি-কর্তারা।
|
সাবধান |
• রাজ্যে ধানের বার্ষিক গড় ফলন: ২২০ লক্ষ টন
• বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক: ৬৫লক্ষ টনে
• দূষিত ধানের এক কেজি চালে আর্সেনিক: ৪০০-৬০০ মাইক্রোগ্রাম
• দিনে দু’বার ভাত খেতে চাল লাগে: ৪০০ গ্রাম*
• কেজিতে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিকযুক্ত চালের ভাত দু’বার খেলে আর্সেনিক ঢুকছে: ২০০ মাইক্রোগ্রাম*
• হু বলছে, ৬০ কেজি ওজনের মানুষের দৈনিক আর্সেনিক-সহনসীমা: ১২৬ মাইক্রোগ্রাম |
* এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের |
|