ভারতের মতো প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকার যে সীমিত গুরুত্ব, তাহার পশ্চাত্পটে গত প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতাটি গুরুতর, সন্দেহ নাই। বাস্তবিক, গোটা দেশ জুড়িয়া তাঁহার সেই বক্তৃতার ‘বিনির্মাণ’ চলিতেছে। কারণ দ্বিবিধ। জাতীয় লোকসভা নির্বাচন মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে, এবং এ বারে জনমত প্রবল ভাবে বহুধাবিভক্ত হইবার সম্ভাবনা, এতখানিই যেখানে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার একটি বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি কী ভাবিতেছেন, তাহার আঁচ পাওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, বর্তমান রাজনীতিতেও সম্প্রতি আম আদমি পার্টির কল্যাণে কংগ্রেস-বিজেপি ইত্যাদি চেনা ছকের বাহিরে যে নূতন অচেনা ছকটি লক্ষিত হইতেছে, তাহার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির সুচিন্তিত অভিব্যক্তির আলাদা গুরুত্ব রহিয়াছে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বলিলেন, ‘গণনৈরাজ্য’ সুবিবেচনা নহে, বরং একান্ত পরিত্যাজ্য, তাহা একটি বাক্যমাত্র নহে, বাক্যের অন্তরালে নিহিত তথ্যাভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বার্তাও বটে।
সম্প্রতি রাজধানীতে যে গণনৈরাজ্য অনুষ্ঠিত হইতেছে, এবং নির্বাচিত সরকার গঠন করিয়াও সরকারই যে ভাবে তাহা অবিশ্রান্ত ভাবে নির্মাণ করিয়া তুলিতেছে, তাহা কেবল রাষ্ট্রপতি নহে, সকল সচেতন মানুষকে উদ্বিগ্ন রাখিয়াছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক দায়িত্ব স্বীকার করিয়াও ধর্না-অবরোধ কিংবা রাস্তায় বসিয়া স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক ফাইল-স্বাক্ষর ইত্যাদির মধ্যে চমক-মাত্রা ষোলো আনা, কিন্তু দায়বোধের পরিচয় এক আনারও কম। প্রশাসন যদিও সমস্ত মানুষের জীবনকেই প্রভাবিত করে, সমস্ত মানুষ কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে সেই প্রশাসন চালাইতে পারে না, এমনকী তাহার নীতি নির্ধারণ করিতেও পারে না। নীতি-নির্ধারণ জনতার গায়ের জোরের বিষয় নয়, জনতার ভোটে যে প্রতিনিধিরা আসিয়াছেন, তাঁহাদের আদর্শভিত্তিক আলোচনা-সাপেক্ষেই সম্ভব। এইখানেই গণতন্ত্র ও নৈরাজ্যের মধ্যে ফারাক। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাহা বিলক্ষণ জানেন, তাই নিজমুখে নৈরাজ্যের সমর্থক বলিয়া নিজেকে ঘোষণা করিয়াছেন। তবে কি না, ক্ষমতারূঢ় হইবার পরই ঘোষণা করিয়াছেন। ঘোষণাটি আগে করিলে গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা তাঁহার দলকেই বাছিয়া লইতেন কি না, তাহা একটি জরুরি, প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। রাজনৈতিক নেতৃবর্গের প্রতি প্রবল ক্ষোভ সত্ত্বেও গণতন্ত্রের প্রতি ভারতীয় নাগরিক বিশেষ আস্থাবান। গণতন্ত্রই এত দিন দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত দল বা ব্যক্তিকে ক্ষমতা হইতে ছুড়িয়া ফেলিবার স্পর্ধা দেখাইয়াছে, জনবিমুখ বন্ধ্যা রাজনীতির প্রতি মৃত্যুবাণ হানিয়াছে, বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে ভোটযন্ত্রের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নানা দল নানা মতকে শাসনের সুযোগ দিয়াছে।
রাষ্ট্রপতি বলিতে চাহিয়াছেন, ‘জনগণের স্বার্থ’ বলিয়া এক কথায় কিছু হয় না। আম আদমির জন্য নীতি প্রণয়ন ও প্রবর্তন করিয়া সকল মানুষকে সুখী করিয়া দিবার প্রতিশ্রুতি নিতান্ত অর্থহীন। এবং বিপজ্জনক। জনগণকে ভুল প্রতিশ্রুতি দিলে তাহারা কেবল বঞ্চিত হইবে না, ভুল রাজনীতিকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিবে। প্রশাসন কখনওই সার্বিক ভাবে জনসমাজের স্বার্থ দ্বারা চালিত হইতে পারে না, হয় তাহাকে একটি বিশেষ স্বার্থ নয়তো একটি বিশেষ আদর্শ বাছিয়া লইতে হয়। রাষ্ট্রপতি যাহা বলেন নাই, সাম্প্রতিক জনরোষের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃ-শ্রেণি সম্পর্কে যে বিরাগ ও বিদ্বেষ দৃশ্যমান, তাহার মধ্যে কিন্তু একটি সঙ্গত আবেগ, নূতন সংস্কারের অবকাশ ছিল। অবিমৃশ্যকারিতার পথে হাঁটিয়া, গণতন্ত্রের বদলে নৈরাজ্যের আবাহন করিয়া তাহাকে কাঁচিয়া গণ্ডূষ করিলে বিরুদ্ধমতাবলম্বী জনতারও লাভ হইবে না, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও সমূহ ক্ষতি হইবে। |