|
|
|
|
ঝুম্পার সংসার |
আজও সুন্দরী। কুড়ি বছর আগে তো সবাই বলত জুহি চাওলার মতো দেখতে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান।
অথচ প্রথাগত সেলিব্রিটি হতে তীব্র আপত্তি। ঝুম্পা লাহিড়ি-কে কাছ থেকে দেখলেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় |
লন্ডনে জন্ম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া। এখন বসবাস রোমে। ঝুম্পা লাহিড়ি প্রকৃত অর্থেই একজন বিশ্বনাগরিক।
আমরা বাঙালিরা, আমাদের মধ্যে যাঁরা সফল, তাঁদের একান্ত নিজস্ব ভাবতে পছন্দ করি। স্তুতির দৃঢ় আলিঙ্গনে তাঁদের শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে পছন্দ করি। আর ঝুম্পা তো সব দিক থেকেই সফল। তাঁর প্রথম বইয়ের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জেতার পরেও ঝুম্পা বহু প্রশংসিত বেস্ট সেলিং নভেল লিখেছেন। কয়েক দিন আগে বুকার প্রাইজের শর্টলিস্টে তাঁর নাম ছিল। আর এই সব যখন হয়েছে, তখন ওঁর বয়স মাত্র চল্লিশ কী তার আশেপাশে!
ঝুম্পা এক অসাধারণ সুন্দরী, প্রায় জলজ্যান্ত ভাস্কর্য। শান্ত। ধীরস্থির। অপ্রত্যাশিত রকম উষ্ণ হাসতে তাঁকে খুব কমই দেখা যায়।
কেউ কখনও বলেনি যে, আপনাকে জুহি চাওলার মতো দেখতে? প্রশ্নের উত্তরে সেই হাসিটা পাওয়া গেল। বললেন, বছর কুড়ি আগে যখন তাঁদের দু’জনের বয়সই আরও কম ছিল, তখন প্রশ্নটা খুব শুনতেন। নিজের সৌন্দর্যকে মোটেও গুরুত্ব দেন না ঝুম্পা। মুখে হাল্কা যে ক’টা বলিরেখা দেখা দিয়েছে, সেগুলো নিয়েও তিনি খুশি। এই ব্যাপারটাই হয়তো তাঁর সৌন্দর্যকে সংজ্ঞাতীত একটামাত্রা দিয়েছে। |
|
বাহ্যিক প্রকাশে লোকে তাঁকে চিনুক, একেবারেই চান না। ঝুম্পা নিজেকে গুরুত্ব দেন না, বিশ্বকে গুরুত্ব দেন। আর ঝুম্পার বিশ্বে কলকাতাকে পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে। কলকাতা লিটারেরি মিট-এর ‘প্রোলগ সেশন’-এ তাঁর বক্তব্য থেকে সেটা কিছুটা আন্দাজ করা গেল।
এক দশকেরও বেশি সাহিত্যিক জীবনে এই প্রথম এত বেশি সংখ্যক শ্রোতার সামনে বক্তব্য রাখলেন তিনি। এই সেশনটা যাতে তাঁর লেখার মতোই সৎ, তীক্ষ্ন, সিরিয়াস আর বিনয়ী হয়, সে দিকে তাঁর গভীর মনোযোগ ছিল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অফিসে বক্তৃতাটা দেওয়ার আগে যখন তিনি সেই সেশনের সঞ্চালক রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন, তখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা গেল। যাঁরা তাঁর কথা শুনতে এসেছেন, তাঁদের জন্য তিনি দিনটাকে স্পেশ্যাল না করে ছাড়বেন না।
ঝুম্পা অপ্রত্যাশিত ভাবে সমালোচনাও দিব্য মেনে নেন। কেউ একটা বললেন যে, গৌরী, ‘দ্য লোল্যান্ডস’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হজম করা কঠিন। উত্তরে ঝুম্পা বললেন, এই উপন্যাসটা ‘দ্য নেমসেক’-এর চেয়ে বেশি কর্কশ। আর বললেন, এই পাঠক তো একটি চরিত্র নিয়ে তাঁর আপত্তি খুব সম্মানজনক ভাবে প্রকাশ করেছেন। একজন তো তাঁকে বলেছিলেন যে, গোটা বইটাই তাঁকে নাড়াতে পারেনি!
এই সব সমালোচনামূলক মন্তব্যে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হয় জিজ্ঞেস করায় ঝুম্পা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এগুলো তো মেনে নিতেই হয়! সেশনের পরের দিকে তিনি বললেন যে, একবার বইটা বেরিয়ে গেলে তার সঙ্গে নাড়ির যোগটা ছিঁড়ে যায়। সমালোচনার যে গুটিকয়েক তির তাঁর দিকে ধেয়ে আসে, সেগুলোর বিরুদ্ধে এটাই বোধহয় তাঁর রক্ষাকবচ।
আজকাল সাহিত্যিকদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করা হয়। প্রথমে তাঁদের লিখতে হবে পরিপূর্ণ শিল্পীর দক্ষতায়, যে শিল্পী আমাদের চোখের সামনে সব কিছু ছবির মতো এঁকে দেবেন। তার পর তাঁদের বইটাকে উগ্র ভাবে বিক্রি করতে হবে যাতে প্রকাশনা সংস্থার কমিশনিং এজেন্টকে রাজি করানো যায় যে, এই পাণ্ডুলিপির উপর ছাপার কালি আর কাগজ লগ্নি করা যাবে। নিভৃত রাইটিং ডেস্ক থেকে বেরিয়ে তার পর তাঁদের প্রকাশ্য জগতের সঙ্গে কথোপকথনে বুদ্ধিদীপ্ত এবং অভিজাত হতে হবে। |
|
কলকাতা লিটারেরি মিট-এর ফাঁকে স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে |
ঝুম্পাকে দেখে বোঝা যায় তিনি প্রথম ভূমিকাতেই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ। তাঁর কাছে লেখাটা প্রধান ব্যাপার নয়, ওটাই একমাত্র ব্যাপার।
ভারতের সব চেয়ে পুরনো লিটারেরি ফেস্টিভ্যাল যে তাদের নবম বর্ষে এসে ঝুম্পাকে আসতে রাজি করাতে পেরেছিল, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?
আর সেখানেও বিস্ফোরণ পিঙ্ক সিটির ভালবাসা এমন ছিল যে জেএলএফ নামে জনপ্রিয় ওই ফেস্টিভ্যালে যে দু’দিন উনি ছিলেন, সেটার বেসরকারি নামকরণ হয়ে যায় ঝুম্পা লাহিড়ি ফেস্টিভ্যাল। এটা শুনে লক্ষ ওয়াটের হাসিটা হেসে ঝুম্পা বললেন, ব্যাপারটা খুব মজার।
কিন্তু তাঁর ঘরে ফেরাটা ছিল কলকাতাতেই! জয়পুরের অস্বাভাবিক ঠান্ডা থেকে ঝুম্পা যে এই শহরের মনোরম রোদ ঝলমলে শীতে এলেন, সেটা বোধহয় প্রতীকী।
টালিগঞ্জ ক্লাবের রোদে ওঁর বাচ্চারা খেলাধুলো করছিল। গুয়াতেমালান-মার্কিন স্বামী অ্যালবার্তোর সঙ্গে তিনি ছায়ায় বসে খুব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। মনে হল এই সময়েই ঝুম্পা সব চেয়ে শান্তিতে আছেন। এটাই ঝুম্পার সংসার। আমাদের প্রশংসার আলো থেকে আগলে রাখা তাঁর বিশ্ব। যে বিশ্ব তিনি নিজে নিজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যে বিশ্বে ভূগোল অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সেটা হতে পারে রোমে, নিউইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে, বা কলকাতায়।
ঝুম্পা সব সময় বলেন যে, কোনও কিছু নিয়েই তিনি বাড়াবাড়ি করেন না। অসাধারণ ফিট এবং স্লিম তিনি। দৌড়তে পছন্দ করেন। সপ্তাহে অন্তত দু’বার ছ’কিলোমিটার মতো দৌড়নো তাঁর চাই-ই। রাইটিং ডেস্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো এক জনের বাইরে যে সময়টা দরকার, সেটা এখান থেকেই পান। এতে তাঁর লেখায় সাহায্য হয়, তাঁর চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার হয়, গল্পে যে সব কাল্পনিক জগৎ তিনি তৈরি করেন, তার সঙ্গে যোগাযোগটা আরও দৃঢ় হয়।
কিন্তু কলকাতার কাছে তিনি স্পেশ্যাল অন্য একটা কারণে। এই শহর তাঁর প্রেরণা। এই শহরে তিনি বেঁচেছেন, তাঁর মা-বাবা-র মাধ্যমে। এই শহরকে তিনি দেখেছেন তাঁদের চোখ দিয়ে। ‘দ্য লোল্যান্ডস’ শুরু হয় তাঁর বাবার বর্ণনা করা টালিগঞ্জ ক্লাব দিয়ে। বইয়ের সব চরিত্র কাল্পনিক। কিন্তু কলকাতা নিয়ে তাঁর বাবার জীবন্ত স্মৃতি ঝুম্পা তাঁর উপন্যাসে তুলি দিয়ে আঁকেন।
তা হলে আসল ঝুম্পা লাহিড়ি কেমন? ওঁকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে নিজেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’-এর সেই সাংবাদিকের মতো মনে হচ্ছিল। যে ট্রেনযাত্রার শেষে বলেছিল, “কথাটা মনে রেখে দেব।” আমিও যে ঝলকটা পেয়েছি, সেটা এত তীক্ষ্ন আর এত ব্যক্তিগত যে প্রকাশ করতে যাওয়া প্রতারণার মতো মনে হচ্ছে। ঝুম্পা ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ। মেপে কথা বলার মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্ব তাঁর কাছে অপরিসীম।
ঝুম্পাকে জানার সেরা রাস্তা হল ওঁর বই পড়া। এই সারল্য, চালাক সাজার এই প্রচণ্ড অনিচ্ছা, এই আন্তরিকতা সবই তাঁর বইয়ে আছে। আর এ সবই তাঁর সংজ্ঞা। উনি উন্নাসিক নন, লাজুক। নিজেকে গুরুত্ব দেন না, বিশ্বকে গুরুত্ব দেন।
কলকাতা তাঁকে নিজের বললে ঝুম্পা খুশি হন। কিন্তু সেটা সাহিত্যিক হিসেবে। উনি বুঝতে পারেন না কেন তাঁর বিয়ের ছবি, তাঁর পরিবারের সঙ্গে অন্যান্য ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি কাগজে ছাপা হয়।
ঝুম্পা তাঁর নিজের শহর কলকাতাকে শুধু লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করতে ভালবাসেন। আর সব চেয়ে বড় কথা, দেখতে ভাল, প্রতিভাবান, বিশ্বজোড়া খ্যাতি যাঁদের তাঁরা সবাই কিন্তু সেলিব্রিটি হতে চান না। ঝুম্পাই তো তার সব চেয়ে বড় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।
ভাগ্যিস! |
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
|
|
|
|
|