|
|
|
|
মোদী প্রসঙ্গ এড়ালেন রাহুল, প্রশ্ন কংগ্রেসেই
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি
২৭ জানুয়ারি |
চলতি মাসের গোড়াতেই সাংবাদিক সম্মেলনে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। রীতিমতো ঝাঁঝালো সুরে বলেছিলেন, “সবল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অর্থ যদি নরহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া হয়, তা হলে সেই দৃঢ়তা আমার দরকার নেই।” দশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পুরোদস্তুর সাক্ষাৎকারে কিন্তু আসন্ন লোকসভা ভোটে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষের প্রসঙ্গ কার্যত এড়িয়েই গেলেন রাহুল গাঁধী। গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করা ছাড়া যত বারই তাঁর প্রসঙ্গ উঠেছে, তত বারই আলোচনার মুখ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি।
কেন?
রাহুল শিবিরের বক্তব্য, মোদীকে সরাসরি আক্রমণ করে তাঁর গুরুত্ব বাড়াতে চাননি তিনি। সেই কারণেই একাধিক বার প্রশ্ন করার পরে মোদী সম্পর্কে সামান্য মুখ খুলেছেন। গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে দোষী করেছেন তাঁকে। এর কারণ হল: রাহুলের মতে, মোদী মুখে সুশাসনের কথা বলছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর আসল লক্ষ্য মেরুকরণের রাজনীতি। এমনিতেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সংখ্যালঘু ভোটের কংগ্রেস-বিমুখতা পুরোপুরি কাটেনি। তার উপর হিন্দু ভোট যদি পুরোপুরি বিজেপি-র বাক্সে যায়, তা হলে লড়াইটা আরও বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। সেই কারণেই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া প্রায় সওয়া এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে রাহুল আজ বারবার বলেছেন, লড়াইটা দুই ব্যক্তির নয়। দু’দলের। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কংগ্রেস এবং বিজেপি-র রাজনৈতিক দর্শনের ফারাকটা।
কিন্তু ঘটনা হল, রাহুলের এই কৌশল নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। দলের একাংশের মতে, যতই বলা হোক না যে, এ দেশের নির্বাচনটা আমেরিকার মতো নয়, এ দেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন লোকসভার সদস্যরা ভোটের ময়দানে কিন্তু এখন লড়াইটা রাহুল বনাম মোদীই। এবং সে ক্ষেত্রে রাহুল যতই মোদী প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছেন, ততই জনমানসে এই বার্তা যাচ্ছে যে, তিনি বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে ভয় পাচ্ছেন। (যদিও রাহুল নিজে আজ বলেছেন, “আমি বাবা-ঠাকুমার মৃত্যু দেখেছি। এর পর আর কিছুকেই ভয় পাই না।”) তা ছাড়া, সংখ্যাগুরু ভোটারদের সকলেই যে মোদীর সমর্থক, এমনও তো নয়। ধর্মীয় মেরুকরণ হলে সেই ভোট আরও বেশি করে কংগ্রেসের দিকে আসবে বলেই দলের ওই অংশের ধারণা।
শুধু মোদীকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে নয়, শিখ দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্নের মুখেও আজ রাহুলকে বেশ নড়বড়ে লেগেছে। গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে মোদীকে দুষলে ওই দাঙ্গার জন্য কংগ্রেসকে দোষ দেওয়া হবে না কেন? রাহুলের জবাব, শিখ দাঙ্গা কোনও সরকার করায়নি। এই দাঙ্গার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী কিনা, এই প্রশ্নও এড়িয়ে গিয়েছেন রাহুল। যদিও মনমোহন সিংহ ইতিমধ্যেই ক্ষমা চেয়েছেন, দুঃখপ্রকাশ করেছেন সনিয়া গাঁধী।
রাহুল আজ কী বলেন তা শোনার জন্য তীব্র আগ্রহ ছিল বিরোধী শিবিরে। তারা দেখতে চেয়েছিল, মোদীর বিরুদ্ধে তিনি খড়্গহস্ত হন কিনা। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কী জবাব দেন। রাতে বিজেপি মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, “রাহুল কিছু তত্ত্বকথা মুখস্থ করে এসেছিলেন। এখনও পরিণত রাজনীতিক হয়ে উঠতে পারেননি তিনি।”
বিরোধীদের সমালোচনা তীব্র হয়েছে দুর্নীতি থেকে মূল্যবৃদ্ধি আমজনতার দুশ্চিন্তার বিষয়গুলি নিয়ে রাহুল সুনির্দিষ্ট কোনও জবাব দিতে না-চাওয়ায়। রাহুল দাবি করেছেন তথ্যের অধিকার, লোকপালের মতো যুগান্তকারী আইন তৈরির পিছনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আদর্শ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বাণ বা উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহের বিরুদ্ধে দল কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব তিনি দেননি। শুধু বলেছেন, আইন আইনের পথে চলবে। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে দোষী সাব্যস্ত লালুপ্রসাদের সঙ্গে কেন জোট বাঁধছে কংগ্রেস, এই প্রশ্নে রাহুলের জবাব, কোনও ব্যক্তি নয়, সমঝোতা হচ্ছে দু’টি দলের মধ্যে।
বস্তুত, দৈনন্দিন রাজনীতির কূটকচালির বাইরে নিজের দর্শনের কথাই আজ শোনাতে চেয়েছেন রাহুল। যার মূল কথা দু’টি। এক চলতি ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানো। দুই, মহিলাদের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়া। তাঁর কথায়, “বাকি সব ব্যাপারে আমি এখন অন্ধ। অর্জুনের মতো দেখছি শুধু দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকেই। যে পরিবর্তন কোনও এক জন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পরিবর্তে মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটাবে।”
তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাহুল যত বারই মানুষের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ তোলেন, তত বারই বিরোধীরা উস্কে দেয় পরিবারতন্ত্রের বিষয়টি। আজ সেই প্রশ্নেরও জবাব দিতে চেয়েছেন রাহুল। তাঁর কথায়, “এমন নয় যে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে গাঁধী পরিবারেই আমার জন্ম হবে। কিন্তু এসে যখন পড়েছি, তখন আর উপায় কী!”
একই সঙ্গে রাহুল জানিয়ে দেন, তিনি পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তবে এক দিনে তা খতম করার মতো কোনও জাদুদণ্ড তাঁর হাতে নেই। তবে দলের বন্ধ দরজা খুলে দিয়ে সেই কাজটাই করতে চান তিনি। এই প্রশ্নে বিজেপি-কে কটাক্ষ করে রাহুলের মন্তব্য, “বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনীত করে তাঁর হাতে সব ক্ষমতা দিতে চাইছে। কিন্তু গণতন্ত্র কোনও একতরফা সিদ্ধান্তের কথা বলে না। সমষ্টির কথা বলে। কংগ্রেস সমষ্টির অধিকারের কথাই বলছে। আমি মানুষকে আরও ক্ষমতা দেওয়ায় বিশ্বাস করি।”
সেই যুদ্ধে এবং আসন্ন লোকসভা ভোটে তিনি জিতবেন বলেই নিশ্চিত রাহুল। কিন্তু যদি হেরে যান, তা হলে সেই দায় স্বীকার করতে যে কসুর করবেন না, সে কথাও আজ জানিয়ে দিয়েছেন রাহুল। |
|
|
|
|
|