সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই কিছু লোক বলে বেড়াতে লাগল, চাঁদে আদৌ মানুষের পা পড়েনি। এ সবই পরম ভাঁওতা। ‘স্পেস রেস’-এ রাশিয়াকে হারাতে আমেরিকার হাই-টেক চাতুরিমাত্র। তাদের নালিশ-কাম-গল্প যে পথে এগোয়, তা এই রকম:
১৯৬১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি আচমকা ঘোষণা করে দেন, চলতি দশক ফুরোবার আগেই আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাবে ও তাদের ফিরিয়ে আনবে। গবেষণা জোরদার করতে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেওয়া হল নাসা-র বরাদ্দ। কিন্তু সময় কিছু গড়াতেই নাসা-র বিজ্ঞানীরা নাকি টের পান, চাঁদে মানুষ পাঠানো তাঁদের কম্ম নয়! তখন কি আর ঢোক গেলা যায়? তা হলে তো রাশিয়ার সঙ্গে মহাকাশ-টক্করে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। তার ওপর প্রেসিডেন্টের প্রেস্টিজ ঢিলে। তা ছাড়া, বন্ধ হয়ে যাবে নাসা-র জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ টাকা।
|
সুতরাং যে কোনও ভাবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করতেই হবে, আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাতে পেরেছে। তত দিনে ষাটের দশক শেষের পথে। ১৯৬৯। প্রেসিডেন্টের চেয়ারে রিচার্ড নিক্সন। নিক্সনের প্রশাসন অনেক মাথা চুলকে শেষমেশ একটা উপায় বের করল। এই পৃথিবীতেই তৈরি করা হবে চাঁদের সেট। সেখানেই শুটিং করে বানানো হবে চন্দ্রাভিযানের নকল ভিডিয়ো। যা যথাসময় ‘লাইভ’ বলে সম্প্রচারিত হবে। আগের বছরই (১৯৬৮) রিলিজ করেছে বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক-এর ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসি’। সেখানে স্পেশাল এফেক্টে দেখানো হয়েছে মহাকাশে অভিযান। মার্কিন প্রশাসন কুব্রিক-কেই দিল ভিডিয়ো ফুটেজ শুট করার দায়িত্ব। তড়িঘড়ি চাঁদের লোকেশন গড়ে তোলা হল আমেরিকার নেভাদা’র এরিয়া ৫১-এ। নাসা-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে দিন নাকি প্রোডাকশন সামলেছিল হলিউডের ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। আর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান-লেখক আর্থার সি ক্লার্ক। আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনকে মুনওয়াক করিয়েছিলেন স্বয়ং কুব্রিক। ১৯৯৯ সালে কুব্রিকের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রীই নাকি কুব্রিকের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাইট দেন। মজার কথা, তা একদা ইউটিউবে থাকলেও, বর্তমানে ভিডিয়োটি কারা যেন লোপাট করে দিয়েছে। আমেরিকা?
কিন্তু এই যে চক্রান্ত-গল্পটা ফাঁদা হচ্ছে, বলা হচ্ছে ওগুলো সব মেকি শুটিং, তার পক্ষে যুক্তিগুলো কী? কী করে বোঝা গেল, চাঁদে মানুষ পৌঁছনোর ভিডিয়োটা স্টুডিয়োতে তোলা, নকল?
প্রথম যুক্তি: নাসা-প্রকাশিত ফোটোগ্রাফগুলিকে সাদা চোখে দেখলেই দেখা যাবে, আর টিভি-সম্প্রচারেও দেখা গিয়েছিল, আর্মস্ট্রং-রা পুঁতে দেওয়ার পর চাঁদে পতপত করে উড়ছে আমেরিকার পতাকা। কিন্তু চাঁদে তো বাতাসই নেই, তা হলে? পতাকাটা উড়ছে কী করে? তার পর, দেখা যায়, চাঁদের মাটিতে নানা বস্তুর ছায়া পড়েছে নানা দিকে একাধিক আলোক-উত্স না থাকলে তো এমনটা হতে পারে না। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? চাঁদে তো ঠিকঠাক আলোর উত্স একটাই: সূর্য! আবার ওই ছায়াগুলোর শেডেও রয়েছে পার্থক্য! তা হলে কি সেটের কৃত্রিম আলো থেকেই এই বর্ণবিপর্যয়? চাঁদের আকাশে মেঘ নেই, সুতরাং ঝকঝকে আকাশে তারা ঝলমল করার কথা। কিন্তু কই? ছবিতে একটিও টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিট্ল স্টারের দেখা নেই কেন? একটি পাথরে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ইংরেজি ‘সি’। ঠিক ঠিক জায়গায় যাতে রাখা হয়, সে জন্য লেবেল-সাঁটা স্টুডিয়োর পাতি প্রপ নাকি? আরও: চাঁদের একাধিক স্থিরচিত্র, যা নাকি বহু মাইল দূরে দূরে থাকা এলাকার আলাদা আলাদা দৃশ্য, সেগুলোয় দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড হুবহু এক রকম। তা হলে কি আঁকা ছবি দিয়ে বানানো একই ব্যাকড্রপ বার বার ব্যবহৃত হয়েছে? প্রশ্ন আছে এমন আরও আরও অনেক। এমনকী ভিডিয়োর এক জায়গায় নাকি দু-তিন সেকেন্ডের জন্য একটি কোকাকোলার বোতলও দেখা গিয়েছিল বলে শোনা যায়!
হয়তো এ সবই জোর করে মেলানো অঙ্ক। গোঁজামিল। তবু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজও কেচ্ছার কুটকুটুনি অব্যাহত। গত প্রায় চল্লিশ বছরে এ নিয়ে তৈরি হয়েছে, হচ্ছে বই কিংবা টিভি শো, ব্লগ কিংবা ‘মকুমেন্টারি’ (মক ডকুমেন্টারি)। সারা বিশ্বের বহু গবেষক, লেখক, তাত্ত্বিক সেই প্রয়াসে শামিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষটি সম্ভবত প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। ২০০৪ সালে আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’-এ চন্দ্রাভিযানের নকল-ভিডিয়ো প্রসঙ্গটি ফের একটু চুলকে দিতে দ্বিধা করেননি! |