গান-বাজনার ক্ষেত্রে শিল্পীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার দৌড়ে মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা। ‘পাবলিক পারফরম্যান্স লাইসেন্স’ বাবদ টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত বড় শহরের পেছনে কলকাতা।
‘ইন্ডিয়ান পারফর্মিং রাইটস সোসাইটি’-র অভিযোগ, কমপক্ষে ৫০% টাকা মার যায় প্রতি বছর। টাকার অঙ্কে যে-লোকসানের পরিমাণ বেশ কয়েক কোটি। মুম্বই শহরের হোটেলগুলি থেকে আদায়ের পরিমাণ ১.২৫ কোটি টাকা। কলকাতায় হোটেল থেকে লাইসেন্স ফি আদায়ের অঙ্ক মাত্র ২৫ লক্ষ টাকা। আর, সব মিলিয়ে সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী কলকাতা থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা লাইসেন্স ফি বাবদ আদায় হওয়া উচিত। সেখানে তা ৫ কোটি। অথচ মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই- সব শহরেই আদায়ের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে মুম্বই। সোসাইটি এই শহর থেকে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা আদায় করে। দিল্লি থেকে তা ১৫ কোটি আর চেন্নাই থেকে ১১ কোটি।
১৯৫৭ সালের কপিরাইট আইনের ৩৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান পারফর্মিং রাইটস সোসাইটি’ (আই পি আর এস)। ১৯৬৯ সালে তৈরি সোসাইটির মূল কাজ গায়ক, গীতিকার ও সুরকারদের হয়ে কপিরাইট আইন মানা হচ্ছে কি না, তার উপর নজরদারি করা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান-সহ শপিং মল, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ডিস্কো, ক্লাব ইত্যাদি স্থানে যে-কোনও গান বাজাতে লাইসেন্স ফি নেয় কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রক অনুমোদিত এই সোসাইটি। লাইসেন্স ফি বাবদ টাকা দেওয়ার আইনের আওতায় আছে হাসপাতাল, চিকিত্সকের চেম্বার, জিমন্যাসিয়াম, বিউটি পার্লারও। লাইসেন্স ফি হিসেবে আদায় করা টাকা থেকেই শিল্পীদের রয়্যালটি দেওয়া হয়।
সোসাইটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান অভিষেক বসুর অভিযোগ, দেশের তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ কলকাতায় লাইসেন্স ফি ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সচেতনতাও নেই। তাঁর দাবি, শুধুমাত্র হোটেলগুলি থেকেই বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা লাইসেন্স ফি বাবদ মার খায় সোসাইটি। তিনি বলেন, “হোটেল মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কপিরাইট সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও লাইসেন্স ফি দিতে অনীহা রয়েছে।”
হোটেল মালিকদের সংগঠন হোটেল অ্যান্ড রেস্টোর্যান্ট ওনার্স অব কলকাতার প্রেসিডেন্ট রাজেশ শেটির অবশ্য দাবি, কপিরাইট নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। তিনি বলেন, “সর্বভারতীয় সংগঠন ফেডারেশন অব হোটেল অ্যান্ড রেস্টোর্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী লাইভ ব্যান্ড না-থাকলে লাইসেন্স ফি দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।” অভিষেকবাবুর পাল্টা দাবি, এই যুক্তি খণ্ডন করে খোদ আদালত রায় দিয়েছে। সেই সুবাদে যে-কোনও গান বাজালেই ফি দেওয়া বাধ্যতামূলক।
সচেতনতার অভাব রয়েছে শিল্পীমহলেও। প্রয়াত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র পিয়াল বন্দ্যোপাধ্যায় এ কথা স্বীকার করে বলেন, “বিষয়টি জানা ছিল না। বাবার মৃত্যুর এক বছর পরে ছায়াছবির বাইরের ১২০০ গান নথিভুক্ত করাই।” সমসাময়িক শিল্পীরা অবশ্য বিষয়টি বোঝেন ও এ নিয়ে ভাবনাচিন্তাও করেন। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানের অনুপম রায়ের মতে, এ ধরনের সোসাইটি থাকা জরুরি। নচেত্ শিল্পীরা কোনও দিন যথাযথ মূল্য পাবেন না। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, সোসাইটির তরফে রয়্যালটি দেওয়া ও লাইসেন্স ফি নেওয়ার ব্যাপারে আরও স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “লাইসেন্স ফি-র মধ্যে কার কতটা প্রাপ্য, সেটা স্পষ্ট হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। নির্দিষ্ট নিয়ম থাকলে সুবিধা হবে।” যদিও সোসাইটির দাবি, যা আদায় হয় তার ১৫% নিজেদের প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য রেখে বাকিটা শিল্পীদের দেওয়া হয়।
সোসাইটির অভিযোগ, আইন জেনেও লাইসেন্স ফি দেয় না বিভিন্ন সংস্থা। ফলে বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে। আর শিল্পীদের ঝুলি শূন্যই থেকে যায়। তবে মুম্বই হাইকোর্ট ও কলকাতা সিটি সিভিল কোর্টের সাম্প্রতিক রায় হোটেলগুলির বিপক্ষে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসছে বিভিন্ন সংস্থা। আর আদালতের হস্তক্ষেপে চিত্রটা ক্রমশ বদলাতে শুরু করবে বলে আশা তাদের।
|