চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
ভাস্কর্যের বিবর্তনে উঠে এসেছে আধুনিকতার চালচিত্র
নিরঞ্জন প্রধান তাঁর ভাস্কর্যের প্রতিরূপ সংগ্রহের একটি স্মারকগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ভাস্কর্য হচ্ছে গড়ে ওঠার উদ্ভাস স্বরূপ। তাঁর সৃজনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেছিলেন: ‘দিবারাত্রি পৃথিবীতে চলেছে প্রাণের স্পন্দন, সেই স্পন্দনের একটুখানি পেতে চাই হৃদয় ভরে’। এ রকম এক অধ্যাত্মচেতনার ভিত্তি থেকে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ১৯৬০-এর দশক থেকে। প্রায় পাঁচ দশকে ব্যাপ্ত তাঁর ভাস্কর্য থেকে নির্বাচিত ৫০টিরও বেশি কাজ নিয়ে পূর্বাপর প্রদর্শনী হল সম্প্রতি আইসিসিআর-এর উদ্যোগে তাঁদেরই দু’টো গ্যালারি জুড়ে। প্রায় অর্ধ শতকের ধারাবাহিক বিবর্তনে কেমন করে প্রথম পর্যায়ে বিমূর্ত থেকে মূর্ত, এর পরে মূর্ত রূপের ভিতরই অরূপের স্পন্দন এনেছেন তিনি তারই পরিচয় পাওয়া যায় এই প্রদর্শনী থেকে।
সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে, ভাস্কর্য বস্তু থেকে গড়ে ওঠা শিল্পরূপ। কবিতা বা চিত্রকলার সঙ্গে এখানে এর বড় রকমের পার্থক্য। কবিতা বা চিত্রে বিমূর্ত ভাবনা বা ‘আইডিয়া’ থেকে গড়ে ওঠে মূর্ত দৃশ্যরূপ। সেটা সব সময়ই ‘কনসেপচুয়াল’। তার কোনও স্পর্শযোগ্য অবয়ব নেই। ভাস্কর্য গড়ে ওঠে বস্তুর বাস্তব থেকে। সেই বাস্তব থেকে উদ্ভাসিত হয় ভাবনার বিমূর্ততা। ইউরোপীয় ভাস্কর্যের আধুনিকতাকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে এই পথ পরিক্রমা করতে। রদাঁ থেকে হেনরি মুর, বারবারা হেপওয়ার্থ বা জিয়াকোমেত্তি পর্যন্ত অভিযাত্রা সেই বিবর্তনেরই ইতিহাস। আমাদের দেশের আধুনিকতায় দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী থেকে রামকিঙ্করের সারা জীবনের বিবর্তনে এই অভিযাত্রায় এক স্বতন্ত্র ধরন প্রতিভাত হয়। স্বতন্ত্র এজন্য যে আমাদের ধ্রুপদী ও আদিম ভাস্কর্যের যে সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, সেই ভিত্তির উপরই আমাদের আধুনিকতা গড়ে তুলতে হয়েছে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সঙ্গে দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা গ্রহণবর্জনের মধ্য দিয়ে। নিরঞ্জন প্রধানের ভাস্কর্যের বিবর্তনে আধুনিকতার বিবর্তনের এই চালচিত্রটাই উঠে আসে।
শিল্পী: নিরঞ্জন প্রধান।
তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালে সুন্দরবনের সজল শ্যামল আবহমণ্ডলে। শৈশবের আট বছর কেটেছে সেখানে। তার পর তিনি চলে যান মেদিনীপুরের গ্রামীণ পরিবেশে। এর পর তিনি আসেন কলকাতায়। লৌকিক ও নাগরিক চেতনার সংঘাত তাঁর ভাস্কর্যের বিশেষ এক মাত্রা। ১৯৬৪-তে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেন চিত্রকলা নিয়ে। ১৯৬৭-তে ভাস্কর্যে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। সেখানে চিন্তামণি কর ছিলেন তাঁর শিক্ষক। চিত্রকলায় তিনি অনেক সময়ই নব্য-ভারতীয় ধারার আঙ্গিক অনুসরণ করেছেন। বাংলার সজল প্রকৃতি ও লোককথা তাঁর ভাস্কর্যকে সম্যক ভাবে প্রভাবিত করেছে।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে আমরা দেখি ১৯৬৬-র ব্রোঞ্জ ‘বার্ড অব প্রে’, ১৯৬৭ ও ১৯৭০-এর কাঠের ভাস্কর্য যথাক্রমে ‘সিটেড উওম্যান’‘ফ্লোরা’। এই ভাস্কর্যে অবয়ব বিমূর্তায়িত হয়েছে ইউরোপীয় আধুনিকতার গাঠনিক বিমূর্ততার অনুষঙ্গে। এই ক’টি ভাস্কর্যে তাঁর নিজস্ব রূপভাবনার কোনও পরিচয় নেই। ১৯৭৮-এর টেরাকোটা ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’। একই বছরে করা কাঠের ‘ফ্লোটিং ফর্ম’-এ এই ‘রূপ’-ই বিমূর্তায়িত হয়ে পরিসর ও শূন্যতার পারস্পরিক মগ্ন খেলায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৮০-র কাঠের ‘হুইর্লউইন্ড’ থেকে ১৯৯০-এর ‘সাঁপুড়ে’ পর্যন্ত চাঁর অভিযাত্রা নাগরিক থেকে লৌকিক রূপবোধে উত্তরণের দৃষ্টান্ত। ২০০৭-এর মার্বলে গড়া ‘বার্থ’ এরই অসামান্য দৃষ্টান্ত। বিমূর্তায়িত একটি পাখি ডিম পেড়েছে। সেই ডিম তিনটি পর্যায়ে প্রস্ফুটিত হয়ে রূপায়িত হচ্ছে চলমান পক্ষিশাবকে। এই ভাস্কর্যে সবটাই পূর্ণ আয়তনের খেলা। কোনও শূন্য পরিসর নেই। এই পূর্ণতা দিয়ে শিল্পী প্রকৃতির যে পূর্ণতা এবং জীবনের যে আবর্তনকে ধরেছেন, সেই ‘প্রাণের স্পন্দন’-এর অনুভবই তাঁর অধ্যাত্মচেতনার ভিত্তি। এরই বিভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখি ২০১০-এর ব্রোঞ্জ ‘স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স’ বা ২০১৩-র ‘লাভ, ফ্রিডম অ্যান্ড পিস’-এ। প্রথমটিতে মাছের ঝুড়িতে ভরে রাখা মাছেরা ঝুড়ির গায়ে বিচরণ করছে, দ্বিতীয়টিতে এক মানবী উড়িয়ে দিচ্ছে অজস্র পাখি।
তাঁর ‘রামমোহন’, ‘উত্তমকুমার’ ও ‘সত্যজিত্‌ রায়ের’ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য সর্বজনপরিচিত। পাশাপাশি রচনাধর্মী ভাস্কর্যে তাঁর যে প্রজ্ঞার প্রকাশ, সমকালীন ভাস্কর্যে তাঁর গভীর অভিঘাত রয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.