শুকনো পাতার উপর শুধু পায়ের আওয়াজটুকুই পেলাম। গাড়ির চালক বললেন এটি চিতাবাঘের। চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। জিম করবেটের কুমায়ুনে মানুষখেকোর দেখা না পেলেও মাত্র কয়েক হাত দূরে শুকনো পাতার উপর তার পায়ের আওয়াজটুকুই ছিল শিহরণ জাগানোর জন্য যথেষ্ট।
গত বছরের জুন মাসের পর থেকে উত্তরাখণ্ড বলতেই সাধারণত চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিপর্যয়ের নানা দৃশ্য। কিন্তু সেই ভুল ধারণা একটা দমকা হাওয়ার মতো উড়ে গিয়েছে কুমায়ুনে পৌঁছে।
|
চৌকরি। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী। |
জ্যোৎস্নায় দূরের পঞ্চাচুলি যেন আরও কাছে এগিয়ে এসেছিল। এখানেই জীবনে প্রথম কস্তুরী মৃগ দেখলাম। চৌকরির মাস্ক ডিয়ার ফার্মে গিয়ে জানতে পারলাম কী ভাবে মৃগের থেকে কস্তুরী সংগ্রহ করা হয়। ভারতে একমাত্র মাস্ক ডিয়ার ফার্ম এটি।
পথ চলা শুরু হয়েছিল অন্ধকার-মাখা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে। রাতে পর্যটকদের যাতে বুঝতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য খাদের দিকের রাস্তায় লাইট রিফ্লেক্টর। পাহাড়ের মাথা উপচে পূর্ণিমার গোলাকার চাঁদের খানিক আলোয় আলোকিত সবুজ উপত্যকা। প্যানগটে যখন পৌঁছলাম রাত তখন সাড়ে ৯টা।
গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডায় হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। গরমাগরম স্যুপে চুমুক দিতে দিতে জেনে নিলাম বৈচিত্র্যময় এই এলাকায় দুশোর বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। কুমায়ুনের নামের সঙ্গেই জিম করবেটের যে মানুষখেকোর গন্ধ মিশে রয়েছে তাও বেশ টের পাচ্ছিলাম।
|
এলাকার বাসিন্দাদের থেকে চিতাবাঘের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কুমায়ুন ঘুরে দেখার পরিকল্পনা যে ভাবে করা হয়েছিল, তাতে বিনসর অভয়ারণ্য বা জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে যেতে তখনও বেশ কয়েকদিন লাগবে।
তবে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। বৃদ্ধ জাগেশ্বর থেকে ফিরছিলাম। সন্ধ্যা নামার মুখে আমাদের গাড়িটা একটা পাহাড়ের বাঁক ঘুরেছে কি গাড়ির আলো এড়াতে একটি চিতাবাঘ তরতর করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেল। শুকনো পাতার উপর দিয়ে তার ভীষণ গতির পায়ের শব্দ শিহরণ জাগানোর মতো।
এতক্ষণ রিজার্ভ ফরেস্টে গিয়ে চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া নিয়ে গাড়িতে সকলেরই জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে উঠেছিল। হঠাৎ রাস্তায় তার দেখা পাওয়ায় সকলেই থ। কারও মুখ থেকেই কোনও কথা বেরোচ্ছিল না। শুধু কানে বাজছিল শুকনো পাতার উপর চিতাবাঘের দৌড়ে চলে যাওয়ার একটা খসখস শব্দ। |
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মুনসিয়ারি পৌঁছলাম। কোথাও কোথাও ধস নেমে রাস্তা অনেকটাই সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে। যতটা সম্ভব ধীর গতিতে গাড়িটা চালিয়ে পার করালেন আমাদের চালক। মুনসিয়ারিতেও একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ওখানে আমরা যে দিন যাই সে দিন বিদ্যুৎ ছিল না। পুরো শহরটাই ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দূরে বাড়িগুলির আলো দেখে মনে হচ্ছিল তারার মতো চকমক করছে। আর গোটা আকাশে যেন কেউ কাচের টুকরো ছড়িয়ে রেখেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হোটেলের বাইরে বসে আড্ডা মারছি। এমন সময়ে দূরে একটা প্রাণীর বিস্ময়কর ডাক শুনে সকলেই বেশ সজাগ হয়ে পড়লাম। মনে হল ঠিক যেন কেউ হাসছে। পরে হোটেলের কেয়ারটেকারের কাছে জানতে পারলাম হায়নার উৎপাত এই এলাকায় খুব বেশি। ডাকটা হায়নারই ছিল। এখানে একটি ‘ট্রাইবাল মিউজিয়াম’ রয়েছে। এই দুর্গম অঞ্চলে আদিবাসীদের জীবনযাপনের কলাকৌশল ধরে রাখা রয়েছে এই মিউজিয়ামে। |
প্রকৃতির মুগ্ধ করা সৌন্দর্যের সঙ্গে এই দশটা দিনে আরও একটা বিষয় খুব অবাক করেছিল। নৈনিতাল, বিনসর, চৌকরি এমন কয়েকটি জায়গা ছাড়া অন্য জায়গাগুলিতে পর্যটক সংখ্যা কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনেক কম। অথচ উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়ালের বিপর্যয়ের কোনও প্রভাবই কিন্তু কুমায়ুনের উপর নেই। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের উষ্ণ আপ্যায়ণ করতে কুমায়ুন ঠিক আগের মতোই প্রস্তুত।
ইতিমধ্যে পায়ে হাঁটা পথে বিনসর অভয়ারণ্য এবং দু’দুবার জিপ সাফারি নিয়ে করবেট ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে ফেলেছি। চিতল, সম্বর হরিণ, ময়ূর, হাতি এমনকি বার্কিং ডিয়ারের অ্যালার্ম কল পর্যন্ত শুনেছি। কিন্তু লেপার্ড বা বাঘের দেখা মেলেনি। তবে কুমায়ুনের পাহাড়ি রাস্তা, দূরে বরফাবৃত ত্রিশূল, পঞ্চাচুলি, নন্দাদেবী এবং কুমায়ুন ঘিরে জিম করবেটের মানুষখেকো বাঘের কাহিনির রোমাঞ্চকর পরিবেশে যা আনন্দ পেয়েছি, তাতে বাঘের সঙ্গে চোখাচোখি না হওয়ার আক্ষেপ ছিল না। |