পুরনো হলেই সব ফেলে দিতে হবে, তেমনটা ভাবা যে ঠিক নয়, সে কথা মনে পড়বে দক্ষিণ বিষ্ণুপুরে গিয়ে। পুরনো জিনিসের সম্ভার নিয়ে সেখানে জমে উঠেছে মেলা। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন শুরু হয়ে সাত দিন চলে এই বিশেষ মেলা, যেখানে আকর্ষণ বলতে মূলত পুরনো জিনিস। কী নেই সেই তালিকায়! সেকেলে দম দেওয়া গ্রামোফোন, রেডিও, পুরনো অ্যান্টিক আসবাবপত্র, ঘর সাজানোর শৌখিন উপকরণ থেকে শুরু করে হাল আমলের টিভি, টেপ রেকর্ডার, ডিভিডি প্লেয়ার কিংবা বিদেশি মিউজিক সিস্টেম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণ বিষ্ণুপুরের এই মেলার বিশেষত্বই এটা।
|
মেলাকে ঘিরে রয়েছে একাধিক কিংবদন্তী। বহু কাল আগে এখান দিয়েই নাকি গঙ্গা বইত। নবদ্বীপ থেকে ওড়িশা যাওয়ার পথে পৌষ সংক্রান্তির সময় শ্রীচৈতন্য এখানে রাত্রিবাসও করেছিলেন বলে কথিত আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা সরে গেলেও তৈরি হয় বড় এক পুকুর। বিষ্ণুপুর শ্মশান লাগোয়া এই পুকুরকেই এখন ‘গঙ্গা’ বলা হয়। আর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এই গঙ্গায় চলে বিশেষ স্নান পর্ব। দূরদূরান্ত থেকে আজও অসংখ্য মানুষ এখানে আসেন স্নান ও মেলার আকর্ষণে। এমনটাই জানালেন মন্দিরবাজার পঞ্চায়েত সমিতির আধিকারিক বিমল হালদার।
মেলা কমিটির অন্য সদস্যরা জানালেন, দিনে দিনে বড় হচ্ছে মেলা। এ বার মেলায় প্রায় ১৬৫০টি দোকান বসেছে। এ ছাড়াও রয়েছে বহু অস্থায়ী দোকান। এত বড় মেলা সামলাতে পুলিশ-প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
এত কিছু থাকতে হঠাৎ পুরনো জিনিসের মেলা কেন?
স্থানীয় বাসিন্দা তাপস বসু জানালেন, গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষ বেশি দাম দিয়ে নতুন আসবাব কিংবা বৈদ্যুতিক সামগ্রী সব সময় কিনতে পারেন না। এই মেলা থেকেই তাঁরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে থাকেন। তবে শুধু দক্ষিণ বিষ্ণুপুর নয়, পুরনো জিনিস কিনতে ভিন্ রাজ্য থেকেও মানুষ ভিড় করেন এই মেলায়। পুরনো জিনিসের এই মেলাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে বাণিজ্য। তাপসবাবু আরও জানালেন, পুরনো জিনিসের মধ্যেই মাঝেমাঝে পাওয়া যায় দুর্লভ এবং দুষ্প্রাপ্য নানা জিনিস। আর সেগুলি কিনতে মেলার প্রথম দিন থেকেই আনাগোনা শুরু হয় বহু সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ীর।
|
তবে মূল মেলা বসে ধানখেতের মধ্যে বিশাল জায়গা জুড়ে। অস্থায়ী সাঁকো পেরিয়ে সেখানে পৌঁছে দেখা যায় দোকানের সারি দু’টি ভাগে ভাগ করা। এক দিকে শুধুই পুরনো আসবাবপত্র। অন্য দিকে, হরেক পুরনো জিনিস। দেখে অবাক হতে হয় আসবাবের দোকানগুলিকে। কী নেই সেখানে! মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, আলমারি, বেলজিয়াম কাচের আয়না কিংবা শ্বেতপাথরের গোল সেন্টার টেবল বা কারুকার্যে ভরা কাঠের সোফা সেট। তবে এরই পাশাপাশি পাওয়া যায় সাধারণ খাট, চেয়ার-টেবল, আয়না ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা আসবাবপত্র।
মেলার অন্য দিকে রয়েছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের অসংখ্য দোকান— পুরনো ঘড়ি, সাবেক টেলিফোন, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, ঝাড়বাতি, পোর্সেলিনের পুতুল ইত্যাদি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরনো বাতিল হয়ে যাওয়া জিনিস কাবাড়িওয়ালাদের হাত ধরেই এই মেলায় পৌঁছয়।
পুরনো হারমোনিয়াম দরদামে ব্যস্ত অজিত দাস জানালেন, মেয়ের জন্য পুরনো একটা জার্মান রিড হারমোনিয়াম কিনতেই কাকদ্বীপ থেকে তিনি মেলায় এসেছেন। অন্য দিকে, শেগুন কাঠের পালঙ্ক দরদামে ব্যস্ত নিউ আলিপুরের অনুপ কেজরিওয়াল বললেন, “কলকাতার চেয়ে এখানে দাম খানিকটা কম।” |
কী বলছেন মেলার আসবাব ব্যবসায়ীরা?
প্রায় ২০ বছর ধরে মেলায় আসা মুজফ্ফর আহমেদ বললেন, “পুরনো জিনিসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জিনিস কম পাওয়া যায়। তাই দাম পড়ে অনেকটাই বেশি। মেলায় কম বেশি ৭-৮ লাখ টাকার ব্যবসা হয়। সাবেক আসবাব কিনতে শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা কলকাতা থেকেই নয়, অন্যান্য জেলা থেকেও মানুষ ভিড় করেন।” হটুগঞ্জ থেকে আসা আবদুল্লা মোল্লার কথায়: “প্রায় সতেরো বছর মেলায় আসছি। পুরনো অ্যান্টিক আসবাবের পাশাপাশি হাল আমলের আসবাবও বেচতে হয়।” কলকাতার আসবাব ব্যবসায়ী কাউস আলি গাজি জানান, এখানে নানা ধরনের ক্রেতা আসেন। শুধু শৌখিন আসবাবই নয়, চলতি আসবাবেরও ভাল চাহিদা আছে।
বাতিল হওয়া পুরনো জিনিস মানেই যে অবহেলার বস্তু নয় তাঁর প্রমাণ মেলে এই মেলায়। মেলার আনাচে-কানাচে দু’চোখ ভরা নেশা নিয়ে আজও ঘুরে বেড়ান বহু সংগ্রাহক। কে জানে, হয়তো খুঁজে পাবেন অজানা খনির নতুন মণি! |
পুরনো খবর: পুতুল নেবে গো, পুতুল |