পুতুল নেবে গো, পুতুল
ণেশজননী, নারায়ণী, কৃষ্ণ-বলরাম, দক্ষিণরায়, বনবিবি— পর পর সাজানো অসংখ্য পোড়া মাটির পুতুল। দেখতে প্রচলিত মাটির পুতুলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। টানা টানা চোখ, গোলগাল গড়নের সাবেক বাংলার এই পুতুলের কদর গোটা পৃথিবী জুড়ে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর-মজিলপুরে তৈরি এই শিল্পসামগ্রী স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট কিংবা ভারতীয় সংগ্রহালয় থেকে দিল্লির জাতীয় সংগ্রহালয়ে। শুধু সংগ্রহালয় নয়, লোকশিল্পের ইতিহাস, এমনকী, লোকশিল্পের বইয়েও স্থান পেয়েছে বাংলার প্রাচীন এই পুতুল শিল্প। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বর্তমানে এই শিল্পকে অনেকেই বিপন্ন বলে মনে করছেন।
তাঁদেরই এক জন জয়নগর-মজিলপুরের পুতুল শিল্পী শম্ভুনাথ দাস। বংশের পরম্পরা মেনে পুতুল তৈরিতে ব্যস্ত শম্ভুবাবু বললেন, “এই শিল্পের অতীত গৌরবময় হলেও বতর্মান কিন্তু অনিশ্চয়তায় ঘেরা। আমাদের আট পুরুষের এই পেশা এখন প্রায় শেষের দিন গুনছে।” তবে থমকে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে তিনি আজও ধরে রেখেছেন বাংলার একেবারে নিজস্ব শৈলীর এই পুতুল শিল্প।
শম্ভুবাবু জানালেন, প্রায় ২৫০ বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন এখানকার দত্ত-জমিদাররা। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে ‘টেপা পুতুল’ তৈরি করতেন। তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে এই পুতুল তৈরি শুরু করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ। তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে। এ ছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে। কিন্তু কত দিন আর পারা যাবে তা নিয়ে সংশয়ে জয়নগর-মজিলপুর।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর উল্লেখযোগ্য। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির ভাল চাহিদা থাকে।
তা হলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কেন?
শম্ভু জানাচ্ছেন, পুতুলের চাহিদা বেশ ভাল হলেও জোগান দেওয়াই মুশকিল হয়। কেন না, পুতুল তৈরি থেকে রং করার কাজ সবই একা হাতে করতে হয়। তা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন মেলায় পুতুলের পসরা নিয়ে হাজির হন তিনি। ক্রেতার হাতে ঐতিহ্যশালী একটা পুতুল তুলে দেওয়ার আনন্দই যে আলাদা। তবে পরিবারে আর কেউই এই পেশায় আসতে আগ্রহী নন।
কাজের ফাঁকে ব্যস্ত ওই শিল্পী বললেন, “মাঝে মাঝেই পুতুল কেনার জন্য বিদেশিরা আসেন আমার বাড়িতে। এই শিল্প সম্পর্কে জেনে ভিন্ দেশ থেকে এসে পুতুল কেনেন, ছবি তোলেন, লেখালেখি করেন। অথচ ঘরের কাছের কলকাতার বেশির ভাগ মানুষ এই শিল্প বিষয়ে উদাসীন। মাঝে মাঝে শহর বা মফস্সল থেকে আসেন কিছু শিল্প সংগ্রাহক। তাঁরা কিনে নিয়ে যান পুতুলের সেট। কলকাতার মেলাগুলিতেও ভাল বিক্রি হয়। তবে সব সামলে কলকাতার মেলায় যাওয়াই মুশকিল।”
তবে শুধু পুতুল তৈরি করে তো আর সারা বছর পেট চলে না। তাই পুজো-পার্বণে শম্ভুবাবু তৈরি করেন হরেক দেবদেবীর মূর্তি। এমনকী, অন্য মৃৎশিল্পীদের কারখানায় কাজও করতে হয় অন্ন সংস্থানের জন্য।
প্রয়াত লোকশিল্প গবেষক তারাপদ সাঁতরা ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পী সমাজ’ গ্রন্থে জয়নগর-মজিলপুরের পুতুলের কথা উল্লেখ করেছেন। কোনও কোনও গবেষক কালীঘাটের পটের সঙ্গে জয়নগর-মজিলপুরের এই পুতুলের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। তবে একটা আশঙ্কা এই শিল্পকে ঘিরে রেখেছে। নতুন করে উৎসাহী শিল্পী এই শিল্পে না আসায় বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পের তালিকায় যোগ হবে না তো জয়নগর-মজিলপুরের এই শিল্প?

ছবি: লেখক।

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.