পুলিশ কি আইনের শাসন বলবত্ করিতে সচেষ্ট হইবে, না কি মন্ত্রীদের নির্দেশে আইনবহির্ভূত তত্পরতায় আপনাকে ব্যস্ত রাখিবে? যে দেশে প্রায়শ মন্ত্রী ও শাসক দলের নেতানেত্রীদের থানায় ঢুকিয়া ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের নির্দেশ দিতে দেখা যায়, দলীয় সমর্থকদের ছাড়াইয়া আনিতেও দেখা যায়, সেখানে পুলিশের পক্ষে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করা এমনিতেই দুঃসাধ্য। তদুপরি যদি মন্ত্রীরা মধ্যরাত্রে পুলিশ অফিসারদের ডাকিয়া তাঁহাদের সন্দেহভাজন কোনও বাড়িতে হানা দিতে জোর-জবরদস্তি করেন কিংবা তাহার বাসিন্দাদের মাদক চোরাচালান ও গণিকাবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করিতে বলেন, তবে তো অবস্থা সঙ্গিন হইবেই। দিল্লির নবনির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের তরফে এমনই অপকাণ্ড ঘটানো হইয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হইল, মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁহার মন্ত্রীদের এই অনাচারকে কার্যত সমর্থন করিয়া পুলিশ অফিসারদের শাস্তি দাবি করিয়াছেন এবং সেই দাবিতে দিল্লির লেফটেনান্ট গভর্নরের কাছে দরবারও করিয়াছেন!
পুলিশের কাজ আইনের শাসন কার্যকর করা এবং আইনসম্মত পদ্ধতিতেই তাহা করিতে হইবে। কোনও মন্ত্রীর মনে হইতেই পারে যে একটি বাড়ি দুষ্কর্মের আখড়া। সেই ধারণা সত্যও হইতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক প্রমাণ ও তাহার ভিত্তিতে আগাম জারি হওয়া পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ কিছুতেই সেখানে আচমকা হানা দিতে কিংবা তাহার বাসিন্দাদের গ্রেফতার করিতে পারে না, মন্ত্রীর নির্দেশেও না। মন্ত্রীদের নিজেদেরও সেটা বুঝা উচিত। পরিবর্তে বিষয়টিকে ‘মর্যাদা’র প্রশ্নে পরিণত করিয়া তাঁহারা পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগের অভিযোগ তুলিতেছেন। ইহা নিন্দনীয়। মুখ্যমন্ত্রীর বরং সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের সাধুবাদ দেওয়া উচিত ছিল তাঁহারা আইন মোতাবেক কাজ করিয়াছেন বলিয়া। বিপরীত কারণে দলীয় মন্ত্রীদের ভর্ত্সনাও করা উচিত ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের কাছে নালিশ ঠুকিতে গেলেন। এই ঘটনা হইতে এক দিকে দিল্লির পুলিশ প্রশাসন, অন্য দিকে জনসাধারণ ঠিক কী শিক্ষা গ্রহণ করিবেন? পুলিশের তরফে শিক্ষাটি হইল, আইন অনুযায়ী কাজ করিলে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়িতে হইবে। আর জনসাধারণ শিখিলেন, যে কোনও অভিযোগ এক বার মন্ত্রীর কানে তুলিয়া দিলেই হইল, তাহার ভিত্তিতেই মন্ত্রীরা পদক্ষেপ করিবেন। উভয় শিক্ষাই গণতন্ত্রের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর। মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের অভিমত, অপরাধ-চক্র ভাঙিবার ব্যাপারে পুলিশি ঔদাসীন্যই দিল্লিতে ধর্ষণ, মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যাবৃদ্ধি করিতেছে। ডেনমার্কের এক মহিলার উপর সাম্প্রতিক গণধর্ষণের অনাচারের জন্যও প্রকারান্তরে তিনি পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করিয়াছেন। পুলিশ অনেক রকম অপরাধের প্রতি চোখ বুজিয়া থাকে, এমন অভিযোগ বিস্তর। সেই অভিযোগের যথেষ্ট কারণও অবশ্যই আছে। পুলিশকে নিরপেক্ষ ভাবে আপন কর্তব্য পালনে বাধ্য করিবার কাজটি জরুরি। সে জন্য দিল্লি সরকারের মন্ত্রীরা নিশ্চয়ই পুলিশ প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে পারেন, করা জরুরিও। কিন্তু তাহার যথাবিহিত পথ আছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়াই তাহা করা যায় এবং করা উচিত। এমনকী সেই ব্যবস্থা সংশোধনের প্রয়োজন থাকিলে তাহার জন্য তত্পর হইবার উপায়ও আছে। সে জন্য আম আদমি পার্টির নেতারা জনমত জাগ্রত ও সংগঠিত করিবার চেষ্টা করিতে পারেন, গণতান্ত্রিক দেশে তাহা নিশ্চয়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু মন্ত্রী পুলিশের কর্তা ও কর্মীদের নির্দেশ দিতে পারেন না, সেই অধিকার তাঁহার নাই। এই জবরদস্তি কেবল অন্যায় নয়, ইহা প্রশাসন তথা গণতন্ত্রের কাঠামোকে দুর্বল করে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁহার আম আদমি পার্টিকে বুঝিতে হইবে, গণতন্ত্র মগের মুলুক নয়। |