হাসপাতালে যাওয়ার আগে আম্মা বলেছিল এ বার বিয়েটা করে নাও

আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অসম্ভব ক্লান্ত...

হ্যাঁ, ঘুমোতে পারছি না। সারা দিন বাড়িতে এত লোক আসছে যে কথা বলতে বলতেই সময় কেটে যাচ্ছে। রাতে বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই রিয়েলাইজ করছি মনটা কী রকম ফাঁকা লাগছে। তখন হিট করছে যে ‘আম্মা’ নেই।

বুঝতেই পারছি আপনার মনের অবস্থাটা।
হ্যাঁ, এটা শ্মশান থেকেই শুরু হয়েছিল। আমি গতকালই প্রথম শ্মশানে যাই। এর আগে কোনও দিন যাইনি। ফিল্মে শু্যটিংয়ে করেছি মৃত্যুর দৃশ্য, কিন্তু রিয়েল লাইফে এই প্রথম। শ্মশানের ইমেজগুলো, কফিন খোলাটা, গান স্যালুট, চিতায় আগুন খালি মনের মধ্যে ওই দৃশ্যগুলোই চলছে। এটার একটা কারণ আছে...

কী সেটা?
কারণ হচ্ছে, এত ক্লোজ কাউকে আমি এর আগে হারাইনি। আই হ্যাভ নেভার লস্ট সামওয়ান সো ক্লোজ টু মি। আমার খালি মনে হত, আম্মা সারা জীবন থাকবে। খালি মনে হত আম্মা এত স্ট্রং যে আম্মার কিছু হতেই পারে না! সেই আম্মাকেই আর কোনও দিন দেখতে পাব না, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে শকিং।

কিন্তু ওঁর শরীর তো অনেক দিন ধরেই খারাপ চলছিল। নিজেকে মেন্টালি প্রিপেয়ার করেননি?
না, আমি করিনি। আমার মনে হত মির্যাকল একটা হয়ে যাবে। আম্মাকে নিয়ে আমরা ঠিক বাড়ি চলে আসব। আমার মনে হয়েছিল মেন্টালি প্রিপেয়ার করাটা একটা নেগেটিভ থট। তাই নিজেকে ওই ভাবে প্রিপেয়ার করিনি। অনেক সময় ডাক্তাররা কেঁদে ফেলছিলেন, বন্ধুবান্ধবরা বলছিল মনটা শক্ত রাখতে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে।

গতকাল সকালে কী হয়েছিল?
আমি বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার সময় বাড়ি ফিরি। বাড়ি ফিরে চিন্তা হচ্ছিল। চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গতকাল সকালে হঠাৎ সাড়ে সাতটায় ফোন বাজায় ঘুমটা ভেঙে যায়। শুনলাম হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। আমার তখনই মনে হয়েছিল সব শেষ। কোনও রকমে নীচে নেমে আমি, রিয়া আর মা ট্যাক্সি ধরি...

ট্যাক্সি?
হ্যাঁ, ট্যাক্সি। আমাদের ড্রাইভার আসে সকাল ন’টায়। অত সকাল সকাল আর কী করে পৌঁছব! ট্যাক্সি ছাড়া উপায় ছিল না। তার পর তো পুরোটাই আপনারা জানেন। এই ফাঁকা লাগার আরেকটা কারণ আমাদের বাড়িটা বড্ড বড়। এত বড় বাড়িতে তাই সাঙ্ঘাতিক ফাঁকা লাগছে।

শুনলাম আজ, শনিবার দুপুরে আপনারা আম্মার ফ্ল্যাটে লাঞ্চ করেছেন সবাই মিলে?
হ্যাঁ, সবাই মিলে আম্মার ফ্ল্যাটে গিয়ে লাঞ্চ করলাম। আম্মার ফ্ল্যাটটাকে আমরা পুরোটাই ফাংশনাল রাখব। সব কিছু আগের মতোই থাকবে।

আপনি কি তা হলে আপনার বেডরুম শিফ্ট করবেন আম্মার ফ্ল্যাটে?
না, সেটা হয়তো করব না। কিন্তু আম্মার ফ্ল্যাটে আরও বেশি করে যাব। আমার সাঙ্ঘাতিক রিগ্রেট হচ্ছে এটা ভেবে যে, আমি কেন আরও বেশি সময় কাটালাম না আম্মার সঙ্গে! কত দিন বাড়িতে একা নিজের ঘরে থেকেছি, ফোনে বাজে আড্ডা মেরেছি। এখন মনে হচ্ছে, ইশ্, এগুলো না করে যদি আম্মার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম...

গতকাল শ্মশানে বলছিলেন মৃত্যুর কিছু দিন আগে নাকি মহানায়িকা আপনাকে বিয়ে করতে বলছিলেন?
(হেসে) হ্যাঁ, ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে। হাসপাতাল যাওয়ার আগে আগে। হঠাৎ আমাকে আম্মা বলল, ‘এ বার তুমি বিয়ে করে নাও’।
ফ্যামিলি ফ্রেম: আম্মার কোলে রাইমা। এই ছবিটাই রয়েছে রাইমার বেডরুমে।
উত্তরে আপনি কী বলেছিলেন?
আমি বলেছিলাম, আম্মা, তুমি সারা জীবন বললে বিয়ে করার দরকার নেই, হঠাৎ কী হল তোমার? তখন আম্মা বলল, ‘না, বিয়ে করেই নাও এ বার তুমি’। আমি মজা করে বলেছিলাম, ঠিক আছে, করে নেব। তুমি ছেলে খুঁজে দাও। আমাকে হেসে বললেন, ‘আমি কোথা থেকে ছেলে খুঁজব তোর...’

মুনমুনদিকেও দেখে একদম বিধ্বস্ত লাগছে।
মাম্মি ইজ শ্যাটারড্। আমাদের থেকে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে মাম্মির। মেয়ে হিসেবে বুঝতে পারছি সেটা। আর আমাদের সঙ্গে আম্মার ক্লোজনেসটা সাঙ্ঘাতিক। আমরা ছাড়া আম্মার আর কিছু ছিলই না। অন্য গ্র্যান্ডপেরেন্টদের বাকি অনেক অ্যাসোসিয়েশন থাকে। আম্মার কাছে আমরাই ছিলাম হার ওয়ার্ল্ড। কাল রাতে শুয়ে তাই আগামী দিনগুলোর প্ল্যান করছিলাম।

কী রকম?
ভাবছিলাম একবার কাজ, শ্রাদ্ধ সব শেষ হওয়ার পর যখন বাড়িতে লোকজন আসা কমে যাবে, তখন মাম্মির আরও ফাঁকা লাগবে। আরও একা লাগবে। আমি সেই রকম প্ল্যান করছি যাতে এর পর থেকে ম্যাক্সিমাম টাইম মাম্মির সঙ্গে থাকতে পারি। দুবাইতে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছি না। সব নর্মাল হয়ে যাওয়ার পর আর আগের মতো সোশ্যালাইজ কি পার্টি করা কমিয়ে দেব। জাস্ট ওয়ান্ট টু বি উইথ মাম্মি।

তার মানে রাইমা সেনকে আরও রেসপন্সিবল করে দিয়ে গেলেন তা হলে সুচিত্রা সেন?
হ্যাঁ, বলতে পারেন সেটা। (হেসে) আমি রেসপন্সিবল হয়ে গিয়েছি দেখলে আম্মা উড হ্যাভ বিন ভেরি হ্যাপি। আর আমার সঙ্গে আম্মার অ্যাসোসিয়েশন-টাও সবচেয়ে স্ট্রং ছিল, কারণ আমি আম্মাকে সব বলতাম। সব কিছু শেয়ার করতাম। সব বলতাম।

মুনমুনদি খুব দুঃখ করছিলেন হাসপাতালে ওই সময় পাশে না থাকতে পারার জন্য।
হ্যাঁ, মা স্নান করতে বাড়ি ফিরেছিল যখন ঘটনাটা ঘটে। কিন্তু আমরা বাড়িতে পরে বলাবলি করছিলাম এটাই মায়া। মাকে কষ্ট দেবে না বলেই মা যেই বেরিয়ে এল, তখনই আম্মা চলে গেল। মাকে আর কষ্ট দিতে চায়নি আম্মা।

শুনছিলাম আপনাকে নাকি হাসপাতালে উনি বলেছিলেন তোমরা এ বার আমাকে ছেড়ে দাও?
শুধু আমাকে না, যারাই ঘরে ঢুকছিল তাদেরকেই বলছিলেন। আর কষ্টটা নিতে পারছিল না। ইট ওয়াজ ভেরি ভেরি পেনফুল। তাই ফ্রাইডে মর্নিং যখন আমরা ঘরে ঢুকলাম, এটাও ভাবছিলাম, উফ্, আম্মাকে আর এই ইঞ্জেকশন, পাইপ, নল ঢোকানো সহ্য করতে হবে না। সে দিন সকালে মুখে একটা অদ্ভুত শান্তি ছিল আম্মার।

তার পর বেনারসি পরালেন?
হ্যাঁ, মাম্মি পরিয়ে দিল। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। শি ওয়াজ লুকিং অ্যাজ গর্জাস অ্যাজ এভার।

গতকাল শ্মশানে দেখছিলাম যখন চিতা জ্বলছিল, তখন আপনি ধোঁয়াটা দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলেছিলেন...
হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছিল ওই ধোঁয়াটার মধ্যে আম্মা আছে। সেটাই দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলেছিলাম। অনেকক্ষণ আকাশের পাখিগুলোকে আর ধোঁয়াটা দেখছিলাম। তার পর মমতাদি এসে আমাকে বসতে বললেন।

মুখ্যমন্ত্রীকে মুনমুনদি নাকি একটা নামও দিয়েছিলেন?
(হাসি) ইয়েস। মমতাদিকে মাম্মি বলত ‘ম্যাজিক মমতা’। যত দিন উনি হাসপাতালে আসতেন, তত দিনই আম্মার অক্সিজেন লেভেল বেড়ে যেত। মানে উনি ঢুকলেন, তখন হয়তো ৭৯। তার পর আমরা একশো টাচ হওয়া অবধি সবাই ওয়েট করতাম। শেষে কয়েক দিন মমতাদির সঙ্গে আম্মার একটা অদ্ভুত বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মমতাদি থাকলে অক্সিজেন লেভেল একশো টাচ করতই। উনি আমাদের ফ্যামিলির পাশে থেকে যা করলেন, আমরা কোনও দিন ভুলতে পারব না। শনিবার বাড়ি এসে শ্রাদ্ধ অ্যারেঞ্জমেন্টের সব ব্যবস্থা করলেন। ফল, মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন।

গত কাল শ্মশানে কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আসেননি?
কিন্তু পিপল, হু ম্যাটার্ড টু আস ইন দ্য ফ্যামিলি, তাঁরা ছিলেন। অনেকে ঢুকতে পারেননি শ্মশানে। গতকাল রাতে বাড়িতে এসেছিলেন বহু মানুষ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফোন করেছিলেন। শ্মশানে যত জন ছিলেন, তাঁদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁদের সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির অন্য একটা বন্ডিং আছে।

থ্যাঙ্ক ইউ রাইমা। এই কঠিন মুহূর্তে এতটা সময় বের করার জন্য।
দ্যাট’স ওকে । কথা বলে হাল্কা লাগল। আপনারা সবাই আম্মাকে এত ভালবেসেছেন... তার জন্য আপনাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

আম্মাকে কিছু বলবেন না?
আম্মাকে বলব, আম্মা, তুমি যেখানেই আছ, সেখানে খুব খুব ভাল থেকো। সবাইকে আনন্দ দিয়ো। সবাইকে ভাল রেখো। মিস ইউ আম্মা...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.