সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের ওষুধ জোগানে দুর্নীতি রুখতে ওষুধের বরাত থেকে বিল মেটানো পুরো পদ্ধতি অনলাইনে সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ বার সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে রোগীরা যাতে নিখরচায় ওষুধ পান, তা নিশ্চিত করতেও স্বাস্থ্য দফতরের সহায় সেই অনলাইন পদ্ধতি।
আর তারই অঙ্গ হিসেবে আসছে অনলাইন প্রেসক্রিপশনের জমানা। দাঁড়ি টানা হচ্ছে আউটডোর টিকিটের উপরে ডাক্তারবাবুদের ওষুধ ‘লিখে দেওয়ার’ রেওয়াজে। দু’টাকার ওই আউটডোর টিকিটই উঠে যাচ্ছে। পরিবর্তে সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে শুরু হতে চলেছে রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ব্যবস্থা। সেটা কী রকম?স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: আউটডোরে আসা প্রতি রোগীর জন্য বরাদ্দ হবে একটা রেজিস্ট্রেশন নম্বর। চিকিৎসক রোগী দেখার পরে রোগীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করে কম্পিউটারেই প্রেসক্রিপশন লিখবেন, যার একটি প্রিন্ট-আউট সই করে রোগীকে দেওয়া হবে। তা দেখিয়ে হাসপাতালের ফার্মাসি থেকে ওষুধ নিতে হবে। রোগীকে কোন ওষুধ দেওয়া হল বা হল না, ফার্মাসিস্টকে সেটা তৎক্ষণাৎ নথিভুক্ত করতে হবে কম্পিউটারে। |
এবং সেই পুরো তথ্য অনলাইনে চলে যাবে স্বাস্থ্য ভবনে। স্বাস্থ্য-কর্তারা মাউসের ক্লিকে জেনে নিতে পারবেন, কোন হাসপাতালে কোন রোগী কী ওষুধ পেলেন, বা পেলেন না। ফার্মাসি কোন ওষুধ রাখছে, বা রাখছে না। কিংবা ডাক্তারবাবু স্টকের ওষুধের বদলে অন্য ওষুধ লিখছেন কি না। কেউ জেনেরিক নামের বদলে ব্র্যান্ড নামের ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেও তা ধরা পড়ে যাবে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য: প্রস্তুতকারী সংস্থাকে ওষুধের বরাত দান, সরবরাহ ও দাম মেটানোর পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে দফতরের কর্মী-অফিসারের ব্যক্তি-ভূমিকা ছেঁটে ফেলে অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। তাতে ফলও মিলছে। একই ভাবে আউটডোরেও এটি সমান কার্যকর হবে।
কিন্তু এখনও তো আউটডোর টিকিট কম্পিউটারে হয়! তা হলে ফারাকটা কী হল?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে জানিয়েছেন, এত দিন আউটডোর টিকিট করানোর সময়ে কম্পিউটারে শুধু রোগীর নাম, বয়স ও ঠিকানা তোলা হতো। কী অসুখ হয়েছে, কিংবা কোন ওষুধ কতটা দেওয়া হল, তার রেকর্ড থাকত না। কারণ, ডাক্তারবাবু টিকিটের উপরেই কলম দিয়ে ওষুধ লিখে দিতেন। ফার্মাসি থেকে কোন ওষুধ দেওয়া হল, আর কোনটা দেওয়া গেল না, তা-ও টিকিটেই লেখা হতো। কোন ফার্মাসি কোন ওষুধ রাখছে না, বা ওষুধ থাকা সত্ত্বেও কোন ডাক্তার আউটডোরে ব্র্যান্ড নামের ওষুধ লিখছেন, তা-ও ধরা যেত না।
নতুন ব্যবস্থায় এ সবই নজরদারির আওতায় চলে আসবে বলে আশাবাদী স্বাস্থ্য-কর্তারা। “ফার্মাসিতে কোন ওষুধের কত স্টক, রোজ সকালে সে তথ্য অনলাইনে আউটডোরের চিকিৎসকদের কম্পিউটারে চলে যাবে। ডাক্তারবাবু সে দিকে নজর রেখে ওষুধ লিখবেন, যাতে একটা ওষুধও রোগীকে বাইরে থেকে কিনতে না হয়। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাও তা-ই।” বলেন স্বাস্থ্য-সচিব।
কর্তারা জানিয়েছেন, আগামী মাসে হাওড়া জেলা হাসপাতাল, এমআর বাঙুর, এসএসকেএমের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি এবং এনআরএসের মেডিসিন বিভাগে এর ‘পাইলট প্রজেক্ট’ শুরু হচ্ছে। ধাপে ধাপে এপ্রিলের মধ্যে তা সর্বত্র চালু করা রাজ্যের লক্ষ্য। গোটা প্রকল্পের জন্য ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এক স্বাস্থ্য-কর্তার কথায়, “বহু বেসরকারি হাসপাতালে অনলাইন প্রেসক্রিপশন চলছে। সরকারি হাসপাতালেও চালু হবে।”
কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ তুলনায় অনেক কম। সেখানে যা সম্ভব, সরকারি হাসপাতালের বিশাল কর্মকাণ্ডের পরিধিতে তা কি বাস্তবোচিত?
প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে। বস্তুত সরকারি হাসপাতালে, বিশেষত মেডিক্যাল কলেজগুলির আউটডোরে রোজ হাজার হাজার রোগীর ভিড় জমে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা কম্পিউটারের গোলমালে মাঝে-মধ্যে টিকিট দেওয়া থমকে যায়। “নতুন ব্যবস্থায় তেমন হলে তো প্রেসক্রিপশনই লেখা যাবে না!” মন্তব্য এক চিকিৎসকের। উপরন্তু সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তারেরা এমনিতেই রোগীর বিপুল চাপ সামলাতে হিমসিম। এমতাবস্থায় প্রতি রোগীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে, ফার্মাসির স্টক মিলিয়ে অনলাইনে প্রেসক্রিপশন করা কতটা সম্ভব, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। আরও প্রশ্ন, রোজ স্বাস্থ্য ভবনে এসে জমা হওয়া অত রিপোর্ট যাচাই করবেন কে?
স্বাস্থ্য-সচিব মলয়বাবু অবশ্য দ্বিধা-সংশয়কে আমল দিচ্ছেন না। “সমস্যার ভয়ে পিছিয়ে গেলে কিছুই হবে না। পাইলট প্রকল্প শুরু হচ্ছে। সুবিধা-অসুবিধে তাতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেই মতো ব্যবস্থা হবে।” বলছেন সচিব। তাঁর ঘোষণা, “সরকার প্রকল্পটি শুরু করতে বদ্ধপরিকর।” |