বছর তেরো আগে একটি জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সূত্র ধরে চালু হয়েছিল রসিকতাটা। নরম পানীয়ের রমরমায় নিম্বুপানির যা হাল হয়েছে, বেসরকারি চ্যানেলের দাপটে আকাশবাণীর অবস্থাও তথৈবচ!
এম টিভি, ভি টিভি কুল হ্যায়, ভুল গয়ে আকাশবাণী
ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি!
এই ২০১৪-র গোড়ায় সাবেক আকাশবাণীর বিস্মরণের প্রক্রিয়াই যেন ঘনিয়ে এসেছে।
গত ৫ জানুয়ারি থেকে আকাশবাণীর কলকাতা ক-র সম্প্রচার কার্যত শোনাই যাচ্ছে না। অনুষ্ঠান রেকর্ডিং, সম্প্রচারের কাজ চলছে, কিন্তু রেডিও খুললেই বোঁ বোঁ শব্দ। কলকাতা খ-র একই দুর্দশা চলছে আরও আগে থেকেই। আকাশবাণীর ডিউটি রুমে ওই বিভাগটির সম্প্রচারের কাজকর্ম এখনও ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। কিন্তু রেডিওয় অনুষ্ঠান শোনা যায় না। একদা জনপ্রিয় বিবিধ ভারতী, স্পেশ্যাল বেঙ্গলি সার্ভিস, বা যুববাণী--- একে একে নিভিছে দেউটি। এক সময়ে আমবাঙালির দিন শুরু বা শেষ হত যে শব্দব্রহ্মের সঙ্গী হয়ে, তা ক্রমশ বঙ্গজীবন থেকে মুছে যাওয়ার জোগাড়। এই অবস্থায় এ রাজ্যে সরকারি বেতারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে আকাশবাণী কলকাতার দু’টি এফএম চ্যানেল।
কেন এই অবস্থা? আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অধিকর্তা স্বপ্না মণ্ডল বলছেন, “যা শুনেছি, কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ দ্রুত ত্রুটি শুধরোনর চেষ্টা করছে। দিল্লিতে প্রসার ভারতীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি।” কলকাতা কেন্দ্রের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্তারা বিষয়টি নিয়ে মন্তব্যে নারাজ। তবে আকাশবাণীর আদ্যিকালের সম্প্রচার যন্ত্র পাল্টে ফেলা না-হলে সমস্যা মিটবে না বলে তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ মনে করছেন। প্রসার ভারতী-র সিইও জহর সরকার সমস্যাটি শুনেছেন। তাঁর কথায়, “কলকাতা থেকে পাঠানো রিপোর্ট খতিয়ে দেখছি। সমস্যা কোথায়, বোঝার চেষ্টা করছি। শীঘ্রই কলকাতা ক চালু করার চেষ্টা করব।”
এমনিতে কলকাতা তথা শহর-লাগোয়া এলাকায় সাবেক আকাশবাণীর অনুষ্ঠানগুলি দীর্ঘদিন অনেকটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিছু একনিষ্ঠ রেডিও-ভক্ত বাদ দিলে কেব্ল টিভি বা এফএম চ্যানেলের দাপট যেখানে কম, একমাত্র সেই সব দূর মফস্সল বা পাড়াগাঁয়েই আপাতত আকাশবাণীর রমরমা। এ বার কলকাতা ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই কট্টর রেডিওপাগলেরা সমস্যায় পড়েছেন। কাটোয়ার প্রৌঢ় সরকারি কর্মী নন্দন সিংহ বলছেন, “রোজ সকালে বিছানায় শুয়ে কলকাতা ক-য় প্রাত্যহিকী থেকে খবর অবধি শোনার অভ্যেস ছাড়তে হচ্ছে। এটা খুবই অশান্তির।”
কলকাতা ক-এর কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান যেমন, রোজকার সংবাদ, মহিলামহল বা শ্রোতাদের চিঠি পড়ার অনুষ্ঠান সবিনয় নিবেদন ইতিমধ্যেই এফএম চ্যানেলগুলিতে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। কলকাতা খ কার্যত মুছে যাওয়ার জেরে খেলার ধারাবিবরণী সম্প্রচার আগেই এফএমে সরানো হয়েছিল। এখন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা সম্প্রচারের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমও এফএম।
ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেশন ব্যান্ডে এফএম চ্যানেলের ঝকঝকে সম্প্রচারের পাশে মিডিয়াম ওয়েভে আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠান এমনিতেই অনেকটা ম্লান শোনায়। নিয়মিত শ্রোতাদের অনেকেই তাঁদের প্রিয় সাবেক আকাশবাণীর অনুষ্ঠানগুলি শুনতে অসুবিধের কথা স্বীকার করে থাকেন। অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটাও ইদানীং কঠিন হয়ে পড়ছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে মিডিয়াম ওয়েভে সাবেক আকাশবাণীর অনুষ্ঠানগুলি চালু রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও। প্রসার ভারতীর কর্তারা এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করতে নারাজ। তবে সবারই মত, এই স্মার্ট ফোনে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে গান শোনার যুগে রেডিও তথা আকাশবাণীর সম্ভাবনা মোটেও মরে যায়নি।
তবে আকাশবাণীর অবসরপ্রাপ্ত কোনও কোনও ইঞ্জিনিয়ার থেকে প্রসার ভারতীর কর্তাদের কারও কারও মতে, মিডিয়াম ওয়েভের উপরে নির্ভর না-করে এফএম ব্যান্ডে ভর করেই আকাশবাণীর সমস্ত অনুষ্ঠানকে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে তা হৃত জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে। সে ক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে নতুন নতুন রিলে স্টেশন। যদিও গোটা বিষয়টিই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনসাপেক্ষ। |