কনকনে ঠান্ডায় কুয়াশা ঢাকা সকালে সর্ষেখেত থেকে ভেসে আসছিল কান্নার আওয়াজ। পাশ দিয়ে যাওয়া মহিলারা কাছে গিয়ে দেখেন, জমির আলে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এক শিশু। পাশে পড়ে এক মহিলার দেহ। তাঁদের দেখে শিশুটি বলে ওঠে, “মাকে ডেকেই যাচ্ছি। মা উঠছে না কেন?”
বৃহস্পতিবার সকালে বর্ধমানের কাটোয়ায় সিপাইদিঘি মোড়ের কাছে খেতে উদ্ধার ওই মহিলাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা জানান, মৃতা সাবিনা বিবির (৩৫) বাড়ি মুর্শিদাবাদের লালবাগে এলাহিগঞ্জে। মায়ের দেহের পাশে বসে থাকা বছর পাঁচেকের শিশুটি পুলিশকে জানিয়েছে, মুর্শিদাবাদ থেকে বুধবার তারা কাটোয়া পৌঁছয়। সঙ্গে ছিল এক ব্যক্তি, যাকে সে চেনে না।
কাটোয়া শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ঘটনাস্থলে গিয়ে এ দিন দেখা যায়, মৃতদেহের পাশে পড়ে একটি ব্যাগ ও জলের বোতল। মাথার কাছে বসে একদৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে শিশুটি। কিছুটা দূরে সর্ষে খেতের ভিতর থেকে পুলিশ মহিলার অন্তর্বাস উদ্ধার করেছে। পুলিশ জানায়, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে এই খুন কি না, দেখা হচ্ছে। ময়না-তদন্তে প্রাথমিক ভাবে ধর্ষণের চিহ্ন মেলেনি বলে কাটোয়া হাসপাতাল জানিয়েছে। তবে দেহরস ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হচ্ছে। |
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এলাহিগঞ্জের মিঠুন শেখের সঙ্গে আট বছর আগে বিয়ে হয় সাবিনার। মিঠুন ভাগীরথীতে নৌকা পারাপার করতেন। বছরখানেক আগে তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তার পর থেকে ছেলেকে নিয়ে সাবিনা নিয়াল্লিশপাড়া হল্ট স্টেশন লাগোয়া বহড়া গ্রামে দিদিমা বানু বেওয়ার বাড়িতে থাকতেন। কাটোয়ার পুলিশ জানায়, শিশুটি জানিয়েছে, ট্রেনে করে কাটোয়া পৌঁছে স্টেশনের কাছ থেকে মা ও এক ‘কাকু’র সঙ্গে সে বাসে ওঠে। কিছুটা দূরে নেমে মায়ের কোলে চড়ে একটি অন্ধকার জায়গায় পৌঁছয়। মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।
শিশুটির কথা অনুযায়ী, ওই ব্যক্তি লম্বা। পরনে ছিল সোয়েটার। তবে কী রঙের, তা সে জানাতে পারেনি। এ দিন শিশুটিকে নিয়ে কাটোয়া স্টেশনে যায় পুলিশ। সে দেখায়, ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে কোথায় পুরি খেয়েছিল, কী ভাবে ওভারব্রিজ দিয়ে গিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোথা থেকে বাস ধরেছিল। জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, “বুধবার দুপুরে বর্ধমানমুখী বাস ধরে ওরা। তার পরে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কোথায় ছিল, জানা যায়নি। বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলা গেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”
এ দিন বিকেলে বাড়িতে বসে সাবিনার দিদিমা বানু বেওয়ার দাবি, “মাস দুয়েক আগে কাটোয়ার এক যুবকের সঙ্গে ফোনে পরিচয় হয় নাতনির। সপ্তাহ দুয়েক আগে এক বার কাটোয়া গিয়েছিল। মঙ্গলবার বিকেলেও সেখানে যাবে বলে বেরোয়। ওই যুবক তাকে বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল।” সাবিনার মা মমতা বেওয়া বলেন, “বুধবার সকালে মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তখনই ও কাটোয়ায় বিয়ে করার কথা জানায়। এ দিন সকালেও ফোন করি। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল। তার পর থেকে চিন্তায় ছিলাম।” সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে জানান তিনি। বর্ধমানের এসপি জানান, কাটোয়া পুলিশের দল পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে মুর্শিদাবাদ রওনা হয়েছে।
এলাহিগঞ্জে মিঠুনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর বৌদি জবা বিবি বলেন, “বিবাহ বিচ্ছেদের পর থেকে আমাদের সঙ্গে সাবিনার কোনও যোগাযোগ নেই। মিঠুন আবার বিয়ে করেছে। রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে এখন কলকাতায় রয়েছে সে।” বর্ধমানের পুলিশ সুপার জানান, স্থানীয় এক বাসিন্দার অভিযোগের ভিত্তিতে খুন, ষড়যন্ত্র ও প্রমাণ লোপাটের মামলা রুজু হয়েছে।
শিশুটিকে আপাতত পুলিশের হেফাজতেই রাখা হয়েছে। মাঝে-মধ্যেই কেঁপে উঠছে শিশুটি। বলছে, “মা-ই তো আমাকে ঘুম পাড়াল। ঘুম ভেঙে দেখলাম, মা ঘুমোচ্ছে। আর উঠল না।” |