অস্ত্রোপচার হয়ে গিয়েছে। মূল্যবান কেমোথেরাপির কোর্স শেষ। রেডিওথেরাপিও সারা। কিন্তু সে সব কিছুই হয়তো কাজে আসেনি। রোগীকে ‘জবাব’ দিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু তার পরেও কিছুটা আয়ু তো থেকে যায়। যত দিন বাঁচছেন, তত দিন তাঁর রোগ-যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করার, তাঁর জীবনের মান যাতে যথাসাধ্য উন্নত করা যায়, সেই চেষ্টা করার কিংবা নতুন করে কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে কোথায় যাবেন রোগী বা তাঁর পরিবার?
ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে জীবনের উপান্তে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। অথচ, এ রাজ্যে সরকারি বা বেসরকারি স্তরে ক্যানসার রোগীদের জন্য ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ বা উপশম-চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে এই পরিষেবা গড়তে উদ্যোগী হয়েছেন অনাবাসী এক ক্যানসার চিকিৎসক। স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, সরকারি স্তরে বিষয়টিকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভবিষ্যতে যৌথ উদ্যোগে রাজ্যে উপশম-চিকিৎসার পরিকাঠামোকে আরও প্রসারিত করার ভাবনা রয়েছে।”
আদতে কলকাতার বাসিন্দা, বর্তমানে ব্রাইটন অ্যান্ড সাসেক্স ইউনিভার্সিটি হসপিটালস্-এর ওই ক্যানসার চিকিৎসক শঙ্খশুভ্র মিত্র ইতিমধ্যেই এ রাজ্যের জন্য ব্রিটেনের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেছেন। গড়ে তুলেছেন চ্যারিটেবল ট্রাস্টও। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর কথা হয়েছে। শঙ্খশুভ্রবাবু জানান, সঞ্জয় মিত্র স্বাস্থ্য-সচিব থাকাকালীন ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। সেই সময়ে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের জন্য উপশম-চিকিৎসার কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু কর্মশালা করে ফল হবে না বুঝেই এ বার সরকারি হাসপাতালে কিয়স্ক গড়তে চলেছেন তাঁরা। সেখানে ক্যানসার রোগী বা তাঁর পরিজনেরা যোগাযোগ করলে নিখরচায় উপশম-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
উপশম-চিকিৎসায় গোটা দেশকে পথ দেখাচ্ছে কেরল। গোটা দেশে ৯২৫টি প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টারের মধ্যে ৮৪০টিই কেরলে। সেখানকার চিকিৎসকেরাও শঙ্খশুভ্রের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। শঙ্খশুভ্রবাবু বলেন, “ধনী হোক বা দরিদ্র, সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক, মৃত্যুর আগের যন্ত্রণাটা একই। যাঁর অনেক টাকা, তিনিও শেষ সময়ে যন্ত্রণাহীন, সম্মানজনক মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে পারছেন না। নিজের অভিজ্ঞতায় বারবার এটা দেখেছি।”
অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের কী ধরনের সহায়তা দেবেন তাঁরা? তিনি জানান, যন্ত্রণা কমানো, জীবনের মান খানিকটা উন্নত করার চেষ্টার পাশাপাশি রোগীর মানসিক জোর বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হবে। রোগীর পরিজনদেরও মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা হবে। বহু রোগী এই সব সময়ে অদৃষ্টের উপরে ভরসা করেন। তাঁদের জন্য থাকবে ‘স্পিরিচুয়াল সাপোর্ট’-এর ব্যবস্থা।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, উপশম-চিকিৎসা একটা সামগ্রিক বিষয়। এ রাজ্যে সেটাই কেউ মানতে চান না। তিনি বলেন, “ক্যানসার রোগীর পেটে জল জমে ফুলে উঠেছে, অথচ হাসপাতাল ভর্তি নিচ্ছে না। কিংবা ক্যানসার রোগীর হাত বা পা ভেঙে গিয়েছে, কেউ তাঁর প্লাস্টার করতে রাজি হচ্ছেন না, এমন আকছার দেখছি। ক্যানসার রোগীর কেমোথেরাপি বা অন্যান্য দামী চিকিৎসায় বিভিন্ন মহলে যত গরজ দেখা যায়, রোগীর অন্তিম সময়ে তার ছিটেফোঁটাও থাকে না। জেলার অবস্থা তো আরও সঙ্গিন। ক্যানসার রোগীর জ্বর বা পেটের অসুখ হলেও ডাক্তাররা ওষুধ দেন না, বলেন ‘ক্যানসারের ডাক্তারের কাছে যান’।”
একই কথা বলেছেন ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “ক্যানসার রোগীর অন্তিম পর্যায়ে বাণিজ্যের সুযোগটা বিশেষ থাকে না। তাই তাঁকে ঘিরে হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের আগ্রহও কম। অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের জন্য বহু রাজ্যে হোম বা হসপিস থাকলেও এখানে নেই।” ক্যানসারের উপশম চিকিৎসক অসীম চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “যন্ত্রণা লাঘব হলেই এক জন ক্যানসার রোগীর জীবনের মান খানিকটা বেড়ে যেতে পারে। এ নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে কাজ হলেও এখানে ভাবনাচিন্তা খুবই কম।”
হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া ব্যথা কমানোর অন্যতম ওষুধ মরফিন এখনও পাওয়া যায় না। নিয়মের হাজারো ঝক্কি মানতে হয়, দামও কম। তাই ওষুধ ব্যবসায়ীদেরও এ নিয়ে একেবারেই মাথাব্যথা নেই। অথচ উপশম-চিকিৎসার মূল উপকরণই হল মরফিন। ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব স্টাডি অব পেন’-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে এ দেশে মরফিনের ব্যবহার ছিল বছরে ১৫৭০ কেজির মতো। পাঁচ বছরে তা আরও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু দেশের সমস্ত যন্ত্রণাকাতর ক্যানসার রোগীর কাছে মরফিন পৌঁছে দিতে হলে বছরে ৩৬,৫০০ কিলোগ্রাম মরফিন প্রয়োজন। এ থেকেই চাহিদা আর জোগানের ফারাকটা বোঝা যায়। উপশম-চিকিৎসার নতুন এই উদ্যোগ সফল হলে মরফিনের ঘাটতিও মেটার কথা। আপাতত তারই প্রতীক্ষায় হাজার হাজার ক্যানসার রোগী। |