প্রবন্ধ ২...
বাঙালি যে ভ্রমণ আজও শেখেনি
বাণীর দাপটে যে রচনা আর মানুষ ঢাকা পড়ে যায়, তার ‘আদর্শ’ উদাহরণ বিবেকানন্দ। জীবনের শেষ চার বছর ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার জন্য বেশ ধারাবাহিক ভাবে বাংলায় কলম ধরেছিলেন তিনি। সাধু ও চলিত বাংলা ভাষার দু’চালকে ব্যবহার করে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব গদ্যরীতি। লিখেছিলেন মৌলিক কিছু বাংলা রচনা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, চল্লিশ বছর হওয়ার আগেই যে সন্ন্যাসী-যুবার প্রয়াণ হল, তাঁকে আমরা বাণীদীপ্ত পুরুষ হিসেবে পুজো করলাম, এখানে ওখানে তাঁর বীরবাণী অভ্যেস মতো ‘লটকে’ দিলাম, কিন্তু তেমন করে তাঁর ‘মৌলিক’ বাংলা লেখা পড়ে দেখলাম না। অন্তত দুটো বড় লেখা তো বেশ চেটেপুটে পড়া যেত: ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ এবং ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’। লেখা দুটো একে অন্যের পরিপূরক।
বিবেকানন্দ স্বল্পায়ু জীবনে দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় গিয়েছিলেন। কখনও ভারতকে চিনতে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাওয়া, কখনও দেশের কথা জাতীয়তাবাদী সমন্বয়ী অধ্যাত্মবাচনের মাধ্যমে বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ‘অভিযাত্রা’। রামকৃষ্ণদেবের প্রয়াণের পর তাঁর শিষ্যরা খুবই সংকটে দিন কাটিয়েছিলেন। কলকাতার এক ভাঙা-বাড়িতে দিনযাপন, খাওয়া-পরার ঠিকঠিকানা নেই। এ-সময় তাঁদের অনেকেই ভারত-ভ্রমণ করেছিলেন। পদব্রজে, খানিকটা ট্রেনে, যখন যেমন। এই পরিব্রজনের অভিজ্ঞতা কেউ কেউ লিখেছিলেন। বিবেকানন্দের গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দের তিব্বত-ভ্রমণের বৃত্তান্ত চিত্তাকর্ষক। সে লেখায় তখনকার ভারতের নানা জনগোষ্ঠীর পরিচয় মেলে।
বিবেকানন্দ এই পর্বে তাঁর ভারতদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনও মৌলিক বৃত্তান্ত লেখেননি। এই ভারত-ভ্রমণের পরেই তাঁর আমেরিকা-যাত্রা, শিকাগোর ধর্মমহাসভার ইংরেজি বক্তৃতার সূত্রে অন্য রকম বাগ্মী সন্ন্যাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, পরে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ড যাওয়া। এই সময়ের কথা তাঁর চিঠিপত্রে রয়েছে, অন্যদের লেখাতেও বিবেকানন্দের কথা পাওয়া যায়। বাংলায় ভ্রমণবৃত্তান্ত রচয়িতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ পরে। তখন তিনি ‘বিশ্বখ্যাত’। মুদ্রণপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজি ও বাংলায় বিবেকানন্দ ও তাঁর সহযাত্রীরা সাময়িক পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলা পত্রিকাটির নাম ‘উদ্বোধন’। সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীত।
বিজ্ঞাপনে প্রধান লেখক হিসেবে প্রকাশিত বিবেকানন্দের নাম। পত্রিকাটিতে ‘ভট্টাচায্যিগিরি’ অর্থাৎ শুকনো অং-বং-চং আর সংকীর্ণ ধর্মকথা যাতে না-ছাপা হয় সে বিষয়ে বিবেকানন্দ খুবই সচেতন, নির্দেশও দিচ্ছেন। এই পত্রিকার জন্যই লিখছেন ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ আর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’। পরে ‘পরিব্রাজক’ নামে ছোট একটা লেখাও লিখেছিলেন, তার সঙ্গে ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ সম্পর্কহীন।
উদ্বোধনের পাতায় ‘অলমিতি’ লিখে পত্রভ্রমণবৃত্তান্ত শেষ করেছিলেন তিনি, শেষ করার সময় জানিয়েছিলেন, ‘ইওরোপ সম্বন্ধে তোমাদের তো নানা কথা শোনা আছে তারা কি খায়, কি পরে, কি রীতিনীতি আচার ইত্যাদি তা আর আমি কি বলবো! তবে ইওরোপী সভ্যতা কি, এর উৎপত্তি কোথায়, আমাদের সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ... অনেক কথা বলবার রইল।’ সেই অনেক কথার নিবন্ধ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’। তাঁর প্রয়াণের কয়েক মাস পরে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর উদ্যোগে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ই বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর প্রকাশিত এক অর্থে তাঁর প্রথম মৌলিক বাংলা বই।
গুরুভাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন বিবেকানন্দ, ‘আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত খুব advertise করে ছাপাক দিকি গড়গড় করে subscriber হবে’। পাঠকেরা কী পড়তে চান বা চান না, পত্রিকার প্রচ্ছদ, লে-আউট কেমন হওয়া উচিত, অন্যান্য চিঠিতেও তা নিয়ে বিস্তর কথা আছে। অর্থাৎ লেখালিখির প্রকাশনা বিষয়ে তিনি খুবই বাস্তববাদী। আর লেখা? জাহাজে করে বিখ্যাত বিবেকানন্দ দ্বিতীয় বার বিলেত যাচ্ছেন। যুবা-সন্ন্যাসীর মনটি সজীব। কনফিডেন্সের অভাব নেই। সব সময় ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হওয়ার চেষ্টাও করছেন না। ইতিহাস-ভূগোল-সংস্কৃতি বিষয়ে মোটের ওপর সচেতন পরাধীন ভারতের এই বাঙালি যুবক জাহাজে করে বিলেত যাওয়ার পথে যা দেখছেন তা নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে প্রায় মুখের ভাষায় ভ্রমণ-বৃত্তান্তে নানা ছবি আঁকছেন। চিঁড়েভাজা আর মুড়ি-মটর চেবানো, মাথা কামানো, ঝুঁট-বাঁধা, শুধু পায়, ধুতি-পরা মাদ্রাজি ফার্স্ট ক্লাসে উঠল। সস্ত্রীক যাচ্ছেন আমেরিকান বোগেশ। সাত বছর বিয়ে হয়েছে, ছটি বাচ্চা। একখানা কাঁথা পেতে ছেলেপিলেগুলোকে ডেকের ওপর শুইয়ে বোগেশ-ঘরনি চলে যায়। খুব ছোটটিকে এক কানতোলা চৌকো চুবড়িতে শুইয়ে বোগেশ আর বোগেশ-পাদ্রিনি তাড়াতাড়ি করে বসে থাকে। মস্কো থেকে আসছে যাত্রী-ভরা স্টিমার। ইউরোপি বেশ পরা তুর্ক, আদা-ইউরোপি বেশে মিসরি, ধুতি পরা কাছাহীন আসল আরব।
অন্য জাতি আর ধর্মের মানুষদের নিয়েই কেবল রসিকতা করছেন তা নয়, বাঙালিদের নিয়েও নানা কথা। দুষ্টু বাঙালি রাজার ছেলে বিজয়সিংহ। বাপের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে কতকগুলো সঙ্গী নিয়ে লঙ্কায় এল বুনো রাজাকে সর্দারের সঙ্গে কোতল করলে। বিজয়সিংহ সেকেলে দুষ্টু বাঙালি। আর একেলে বাঙালি? মেয়েমান্ষের মতো বেশভূষা, নরম নরম বুলি, এঁকেবেঁকে চলা, চোখের ওপর চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। হালকা চালের পাশাপাশি বড় কথাও আছে। হচ্ছিল হাঙর শিকার আর সুয়েজ খালের কথা, তার মধ্যেই এসে গেল শ্রমজীবীদের প্রসঙ্গ। এই শ্রমজীবীরা নীরবে কাজ করেন বলেই তো সভ্যতার রমরমা। বিবেকানন্দ তাই উদাত্ত ভঙ্গিতে লেখেন, ‘হে ভারতের শ্রমজীবি তোমাদের প্রণাম করি’। যাত্রাপথের বৃত্তান্ত লিখলেই তো হবে না, সাগর ডিঙিয়ে যে বিলেতে গেলেন সেই বিলেতের সঙ্গে নিজের দেশের মানুষের রীতিনীতির তুলনা করা চাই। তাঁর মতে দু’দলের দু’দলের কাছ থেকে শেখার, নেওয়ার আছে।
শেখার আছে আদেখলা ট্যুরিস্ট বাঙালিরও। ভ্রমণ মানে মন দিয়ে দেখা। লিস্টি মিলিয়ে ঘোরা নয়। দেখার মন বিবেকানন্দের ছিল। সেই মন নিয়ে ‘প্রাচ্য’ ও ‘পাশ্চাত্য’ দু’দলকেই আবার দরকার মতো ধমকেছেন। এ জন্যই তো ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ লেখা। ময়রার দোকানে কলকাতা ছেয়ে গেল। লুচি কচুরি খেয়ে জাতটা গেল। কলকাতার লোক মোহিনী ময়দায় মজল। তার দেখাদেখি বীরভূম বাঁকড়ো ধামা ধামা মুড়ি দামোদরে ফেললে। ‘সভ্য শহুরে লোক! তোমাদের মুখে ছাই।’ আর পাশ্চাত্য? ‘তুমি ইওরোপী, কোন্ দেশকে কবে ভালো করেছ?’ দুর্বল জাতি পেলেই তাদের জমিতে বাস করেছ। ‘কোথা সে সকল বুনো জাত আজ? একেবারে নিপাত, বন্য পশুবৎ তাদের তোমরা মেরে ফেলেছ।’
নিজের দেশ, উপনিবেশ, নানা জাত, এ-সব নিয়ে সজীব ভাষায় লেখা এই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত আমাদের আম-পাঠকের কাছে অনেক সময় ধরা পড়ে না। তার কারণ নানা। তাঁর নামে প্রচলিত খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত বাংলা বাণী ও রচনায় এই মৌলিক বাংলা লেখাগুলি প্রথমেই ঠাঁই পায়নি, আছে পরবর্তী একটি খণ্ডে। বই-সাজানো বাঙালি পাঠক সেই পরবর্তী খণ্ড অবধি যান না। আলাদা করে বইগুলো পাওয়া যায়, তবে এগুলি যে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, বাঙালি পাঠক তা মানতেই চান না, সর্বমান্য বাণী হিসেবে তুলে ধরতে চান। ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’কে পরে ‘পরিব্রাজক’ নামে বই করা হল। সারদানন্দ বইয়ের পরিচয় দিলেন উচ্চকণ্ঠ সাধু ভাষায়, ‘হে পাঠক! প্রাচীন পরিব্রাজক আশীর্বাণী উচ্চারণ করিয়া দ্বারে দণ্ডায়মান।’ ব্যস, আম-পাঠক ভ্রমণ-বৃত্তান্তকে আশীর্বাণী ভেবে বই তাকে তুলে পুজো করতে লাগলেন। আর পড়লেন না। বিবেকানন্দ তাঁর লেখায় পাঠকবন্ধু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাণীমূর্তির দাপটে তাঁর তাজা লেখাগুলো পাঠকদের থেকে দূরেই রয়ে গেল।

বিশ্বভারতীতে বাংলা শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.