অরবিন্দ কেজরিওয়াল জনতা দরবারের আবিষ্কর্তা নহেন। বিভিন্ন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহাদের সহমন্ত্রীরা নিয়মিত জনসাধারণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া থাকেন। ইহা কোনও নূতন রীতিও নহে, অতীতেও এমন সাক্ষাৎ দর্শন ঘটিয়াছে। কেবল রাজ্যে নয়, কেন্দ্রেও ইন্দিরা গাঁধীর আমলে প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী দর্শনার্থীদের মুখোমুখি হইতেন। কিন্তু এই সকল দরবারই পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত। দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জনতা দরবার যে শুরু হইবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হইয়া গেল, তাহার কারণ, কেজরিওয়াল একটি মুক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত দরবার বসাইয়াছিলেন। ভুল করিয়াছিলেন। দেওয়ান-ই-আম-এর ধারণাটিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কোনও না কোনও ভাবে দর্শনার্থীর সংখ্যা ও তাঁহাদের দাবিদাওয়া পেশ করিবার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা আকবরের আমলেও জরুরি ছিল, আজও আছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, তাঁহারা জনসাধারণের এই পরিমাণ সাড়ার প্রত্যাশা করেন নাই। আম আদমি পার্টির অধিনায়ক আম আদমির উন্মাদনা অনুমান করিতে পারেন নাই, ইহার মধ্যে কিঞ্চিৎ পরিহাস আছে। কিন্তু একই সঙ্গে ইহাও মানিতে হইবে যে, এক দিনের অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইয়া আপ-এর নায়করা জনতা দরবার প্রত্যাহার করিয়াছেন এবং সাফ জানাইয়া দিয়াছেন যে, তাঁহাদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। বিবিধ প্রাচীন রাজনৈতিক দলের প্রবীণ নেতারা কেজরিওয়ালদের অপরিণতি লক্ষ করিয়া নানাবিধ তির্যক মন্তব্য করিয়াছেন। স্বাভাবিক। তবে ভুল স্বীকারের অনায়াস তৎপরতা দেখিয়া তাঁহারাও নিশ্চয়ই চমৎকৃত। ভুল তাঁহারাও বিস্তর করিয়া থাকেন, কিন্তু স্বীকার করিতে করিতে কল্পকল্পান্তর কাটিয়া যায় এবং সেই স্বীকারোক্তিও সচরাচর সান্ধ্যভাষায় সমাবৃত থাকে।
জনতা দরবার বৃত্তান্ত যেখানে শেষ হইয়াছে, সেখানেই একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম হয়। একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদৌ কোনও ধরনের জনতা দরবারের প্রয়োজন হইবে কেন? প্রজারা নির্ধারিত সময়ে রাজার সাক্ষাৎ পাইবেন, তাঁহার নিকট অভিযোগ বা প্রার্থনা নিবেদন করিবেন, প্রতিকারের সুযোগ পাইবেন, ইহা তো মজ্জায় মজ্জায় একটি অগণতান্ত্রিক রীতি। যথার্থ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রশাসন ব্যক্তিনির্ভর নয়, নীতি ও ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। যদি নীতি ভুল হয় অথবা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে প্রতিকারের উপায়ও সেই ব্যবস্থাতেই নিহিত থাকিবে, মানুষ সেই উপায় কাজে লাগাইয়া আপন অভিযোগ বা দাবি জানাইতে পারিবেন। এখানেই প্রজা এবং নাগরিকের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য। প্রজা প্রার্থী, নাগরিক অধিকারী। যে মুহূর্তে নাগরিক রাজপুরুষের দরবারে আসিয়া অধিকারের ‘দাবি’ জানাইতেছেন, তিনি কার্যত প্রার্থীতে পরিণত হইতেছেন, সেই দরবার নীতীশ কুমারেরই হউক অথবা অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরই হউক। বস্তুত, কথাটি কেবল দরবারের ক্ষেত্রে সত্য নয়, সাধারণ ভাবেই ভারতীয় গণতন্ত্রে এই রাজা-প্রজা সম্পর্কের প্রভাব আজও অত্যন্ত প্রবল এবং প্রকট। কেবল সনাতন ভারতের গ্রামে নয়, আধুনিক ইন্ডিয়ার শহরেও নির্বাচনী মরসুমে ভোটপ্রার্থী এবং ভোটদাতাদের মধ্যে যে লেনদেন চলে, তাহা বহুলাংশে দাতা ও গ্রহীতার লেনদেন। কেজরিওয়াল যদি প্রজাকে সত্যই নাগরিকের আসনে বসাইতে চাহেন, তবে এই মৌলিক রীতি হইতে শতহস্ত দূরে থাকুন। তাঁহাকে এবং তাঁহার সহকর্মীদের অবশ্যই নাগরিকদের সহিত যথাসম্ভব যোগাযোগ রাখিতে হইবে, সরাসরি তাঁহাদের দাবি ও অভিযোগ জানিবার ব্যবস্থাও জরুরি। কিন্তু সে জন্য দরবার বসাইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। অন্য অনেক উপায় আছে। তাঁহারা ইতিমধ্যেই সেই পথে হাঁটিতেছেন। ভাল। তবে অভিযোগ শোনা প্রতিকারের প্রথম শর্ত। পরের কাজ প্রশাসনকে নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সচল করা। সেখানেই প্রকৃত পরীক্ষা। |