|
|
|
|
বিশ্বগ্রাম ইন্সট্যাগ্রাম |
ফেসবুকে ঢুকে পড়ছেন মা-বাবা থেকে বস। জেন ওয়াই কি তাই
এখন নতুন ঠিকানার খোঁজে? লিখছেন অরিজিৎ চক্রবর্তী |
বছর দেড়েক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। নিয়ম করে ‘অ্যাপ অব দ্য ইয়ার’য়ের তকমাটা ঝুলিতে পুরে নিচ্ছিল ফেসবুক।
হবে না-ই বা কেন? একশো কোটি লোক তো তাকে পছন্দ করে। প্রতিদিন নিয়ম করে ঢুঁ মারছে সেখানে।
কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিপদ আগে থেকে আঁচ করতে পারে। পৃথিবীর কনিষ্ঠতম ‘বিলিয়নেয়র’ মার্ক জুকারবার্গও নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। না হলে ইন্সট্যাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট-এর মতো অ্যাপস কেনার দিকে হাত বাড়াবেন কেন!
উত্তরটা পেতে দেরি হল না। “ফেসবুক ভীষণ বোরিং,” বলছিলেন আইআইএমসি-র ফার্স্ট ইয়ারের শ্রেয়া বসু। কেন? “বড় বড় স্টেটাস আপডেট, চারশো শব্দের কমেন্ট, টাইমলাইনের পাশে বিজ্ঞাপনের ভিড়— উফ্, বিরক্তিকর।” শ্রেয়ার তিন বন্ধুর গলাও একদম একই সুরে বেজে উঠল।
তবে? জেন ওয়াই কি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ছেড়েই দিল? “তা কেন, ইন্সট্যাগ্রাম তো আছে,” উত্তর দিলেন শ্রেয়ারই এক ব্যাচমেট সম্পূর্ণা রায়।
এঁরাই শুধু নয়, ইন্সট্যাগ্রামে মজেছেন শেন ওয়ার্ন থেকে বিরাট কোহলি। এনরিকে ইগলেশিয়াস থেকে শাকিরা—এমনকী শ্রেয়া ঘোষাল, দীপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, সোনম কপূর, আলিয়া ভট্ট-রাও।
লেখকদের মধ্যে রয়েছেন পাওলো কোহেলহো থেকে চেতন ভগত। এমনকী ইন্সট্যাগ্রামে পা বাড়িয়েছেন টেক স্যাভি অমিতাভ বচ্চনও।
চক্ষু চড়কগাছ হয় শাকিরার ফলোয়ার দেখে—এক কোটি চল্লিশ লক্ষ! ভাবা যায়?
|
|
২০১২ থেকে ২০১৩-র মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে
বেড়েছে ৯%, সেখানে ইন্সট্যাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০০% |
আমার তো কোনও বন্ধু নেই
ইন্সট্যাগ্রাম। অ্যাপসের জঙ্গলে কার্যত চারাগাছ। ২০১০-এর অক্টোবরে এসেছিল বাজারে। শুরুতে ছিল ফোটো আর ভিডিয়ো আদানপ্রদানের একটা মাধ্যম। কিন্তু এক বছর কাটতে না কাটতেই পুরোদস্তুর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জায়গা করে নিল। ২০১২ থেকে ২০১৩-র মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে বেড়েছে ৯%, সেখানে ইন্সট্যাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০০%। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, তিনশো শতাংশ কিন্তু ইন্সট্যাগ্রাম নিয়ে এই ‘ক্রেজ’-য়ের কারণটা কী? “মা-বাবা ফেসবুক ব্যবহারে আপত্তি জানাত। স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তার জন্য। ওরা ফেসবুক জানে। কিন্তু ইন্সট্যাগ্রাম পেয়েছিলাম। ওটা তখন তো শুধু ছবির সাইট-ই মনে হত। এখন আমার ফেসবুক-ইন্সট্যাগ্রাম দু’টো অ্যাকাউন্টই আছে, কিন্তু ফেসবুকে তেমন কোনও বন্ধু নেই। ফ্রেন্ড-ই যদি না থাকল, তবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কটা করব কার সঙ্গে। তাই ইন্সট্যাগ্রাম,” বলছিলেন ক্লাস টুয়েলভের ঈশিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কথা কম, কাজ বেশি
বন্ধুদের দল না থাকা যদি ফেসবুকে ভাটা পড়ার একটা কারণ হয়, ইন্সট্যাগ্রামের ব্যবহারিক দিক অবশ্যই ঠেলে দিয়েছে সে দিকে। ফেসবুকে তো খালি ছবি দেওয়া যেতে পারে, সে ছবি এডিট করতে কিন্তু অন্য কোনও অ্যাপস বা সফ্টওয়ারের প্রয়োজন হবে। সে দিক থেকে ইন্সট্যাগ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনও ছবির ক্রপিং, এডিটিং, ছোটখাটো টাচ আপ— ইন্সট্যাগ্রামই করে দেবে। অবশ্য তা বলে ভাববেন না, পেশাদার ফোটো এডিটিং সফ্টওয়ারের আর প্রয়োজন হবে না! কিন্তু প্রতিদিনের কাজ তো মিটে যাবে। কম আলোয় তোলা কোনও ছবিকে উজ্জ্বল করতে হাজার পাঁচেকের সফ্টওয়ার তো আর লাগল না।
সেন্ট জেভিয়ার্সের ঋতম বর্মন ইন্সট্যাগ্রামের জনপ্রিয়তার আরও একটা কারণ জানালেন। “ফেসবুক মানেই কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা ইন্টারনেট মাস্ট। না হলে কোনও মানেই হয় না। আর স্মার্টফোনে চব্বিশ ঘণ্টার ইন্টারনেটের জন্য যে ডেটা প্লান লাগবে, তা পকেট মানিতে কুলাবে না। তার থেকে ইন্সট্যাগ্রাম ভাল। কলেজ ক্যান্টিন আর কফিশপের ফ্রি ওয়াই-ফাই থেকে ছবিগুলো আপলোড করে দিলেই হল,” হাসতে হাসতে বলছিলেন ঋতম।
আর আছেন সেলিব্রিটি। মানতে চান আর না চান, লোকে সেলিব্রিটিদের দেখতেই বেশি পছন্দ করে। এখানে নিক জোনস কী রিহানাকে ফলো করলে, তাঁদের নতুন ট্যাটুর হদিশ, বা জাস্টিন বিবার-সেলেনা গোমেজের প্রেম টিকল না ভাঙল— সে তো আপনারই নখদর্পণে। তবে সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয়তার পরও ইন্সট্যাগ্রামের উঠোনে ভারতীয় সেলিব্রিটিদের কোলাহল যে এখনও তেমন সোচ্চার নয় তার কারণ একটাই, এ দেশে সব রকম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জনপ্রিয়তা এসেছে দেরিতে। |
|
ফেসবুক |
ইন্সট্যাগ্রাম |
• প্রধানত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট।
• লাইক, কমেন্ট করা যায়। তবে ফ্রিতে
বিজ্ঞাপনও হজম করতে হবে।
• ছবি এডিটের ব্যবস্থা নেই।
• যে কোনও ছবিতে ট্যাগ হওয়া বিরক্তিজনক।
• সার্চ করার ব্যবস্থা তেমন ভাল না। |
• ছবি ও ভিডিয়ো আদানপ্রদানের সাইট।
• এতেও লাইক, কমেন্ট আছে। তবে
বিজ্ঞাপন সহ্য করতে হবে না।
• ফিল্টারে ছবি একদম মনপসন্দ।
• ট্যাগ হবে না, শুধু ‘@নাম’ দিয়ে মেনশন করা যাবে।
• সহজেই ‘#বিষয়’ ব্যবহার করে সার্চ করা যায়। |
|
|
সেকেন্ড বার্থ ডে-র ছবি দেখতে চাই না
সেলিব্রিটিরা পিছিয়ে থাকলেও আম-জেন ওয়াই কিন্তু পিছিয়ে নেই। কী ভাবছেন? তারা ফেসবুক আন-ইন্সটল করে দিল নাকি! না, তা নিঃসন্দেহে করেনি। এখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সিংহাসনে মার্ক জুকারবার্গ-ই বসে। তবে অন্য একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে ফেসবুকে। জেন ওয়াই-য়ের সঙ্গে কিন্তু জেন এক্স-য়ের সদস্যরাও আছেন ফেসবুকে। সেই গ্রুপে কিন্তু বাবা-মা থেকে বস— সবাই আছেন। “যখন তখন কেস খেতে পারি। এক দিন ছুটি নিলাম শরীর খারাপ বলে। পরের দিন দেখি এক বন্ধু ওয়াটার পার্কে আমাদের ছবি দিয়ে ট্যাগ করে দিয়েছে। ব্যস, কেস বসের কাছে,” হাসতে হাসতে বলছিলেন শুভদীপ হাজরা।
এই সমস্যাটা এখনই ইন্সট্যাগ্রামে নেই। সেখানে কেউ আপনার অন্নপ্রাশনের ছবি আপলোড করে দেবে না (হ্যাঁ, মা-ও এখন ছবির হার্ড কপি স্ক্যান করে আপলোড করতে শিখে গিয়েছেন), বাবা-র প্রথম ‘সেলফি’তে নিজে ট্যাগড্ হওয়ার কোনও চান্সই নেই। “বাড়ির মধ্যে ঠিক আছে। মা তো ফেসবুকেও আমার বাড়ির ডাকনাম ধরে কমেন্ট করে। ভীষণ অস্বস্তিকর,” বললেন বছর পঁচিশের দেবাদৃতা সেন।
হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যায় না
আগের প্রজন্ম ফেসবুকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে জেন ওয়াই পাড়ি দিচ্ছে ইন্সট্যাগ্রামে, এমন কথা মানতে চান না প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অংশুমান সরকার। বললেন, “নিজে যা করছে তা আগের প্রজন্ম দেখে ফেলল, এ নিয়ে আমার মনে হয় না জেন ওয়াই আদৌ চিন্তিত। ফেসবুক থেকে ইন্সট্যাগ্রামে জেন ওয়াই-য়ের শিফট করার কারণ আমার কাছে বরং মনে হয় কৌতূহল। এটা সব জেনারেশনেই ছিল। নতুন যা কিছু, সেটাই এক্সপ্লোর করা। আগে যেমন অরকুট ছিল, তার পর এল ফেসবুক... এখন দেখছি ইন্সট্যাগ্রাম। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কি আর বন্ধু হয়? তবে ইন্সট্যাগ্রামে যে ছবি দেখানো যায়, ওই ‘শো অফ’ করাটা কিন্তু ভীষণ ভাবে এখন সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে যায়। সেটাই হয়তো ইন্সট্যাগ্রামের ক্রেজের কারণ।”
বিশেষজ্ঞেরা কিন্তু ভীষণ ভাবে ‘ছবি’র গুরুত্বের কথা বলছেন। তাঁদের মতে, ফেসবুক আর ইন্সট্যাগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। লোকে ফেসবুক ব্যবহার করে। আর ইন্সট্যাগ্রামকে ভালবাসে। না হলে কেন ১২ এপ্রিল ২০১২, ইন্সট্যাগ্রাম-কে ফেসবুক কিনে নেওয়ার পর অভিমানে ‘আন-ইন্সটল’ করে দেবে জেন ওয়াই! কারণ ইন্সট্যাগ্রামে ছড়িয়ে আছে তাদের ভাল-মন্দ-সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার নানা রঙের ছবি। কে না জানে আর্থার ব্রিসবেনের সেই কথাটা, “আ পিকচার ওয়ার্থ আ থাউজেন্ড ওয়ার্ডস।”
অতঃকিম
সাইটে যে, হাত বাড়ালে বন্ধু পাওয়া যায় না, বা ‘বাড়ানো হাত বন্ধু সবাই হয় না’, সে কথা তো একশো শতাংশ ঠিক। কিন্তু ইন্সট্যাগ্রামের ছবিতে যে ‘কানেকশন’ তৈরি করা যায়, ফেসবুকের স্টেটাস মেসেজে কি সেই সংযোগ ততটা হতে পারে? নাকি হতেও পারে। জেন ওয়াই-ই হয়তো পারছে না মনের ভাব ভাষায় প্রকাশ করতে?
‘প্রশ্নগুলো সহজ’, তবে উত্তরটা কি কেউ জানে! |
|
|
|
|
|