হাওয়া মোরগের দিক বদলের সঙ্গে শীতের আসা-যাওয়া! অন্তত এ মরসুমের বঙ্গভূমি তারই সাক্ষী! পৌষ পার্বনের দু’দিন আগেও কনকনে শীতের দেখা নেই!
দিন কয়েক আগে উত্তুরে বাতাসের দৌলতে তাপমাত্রা সবে নামতে শুরু করেছিল। শনিবার সেই বাতাসের অভিমুখ পুরো উল্টো হয়ে যায়, বইতে থাকে সমুদ্রের দিক থেকে। অর্থাৎ উত্তুরে হাওয়া বদলে গেল দখিনা বাতাসে, যা সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প বয়ে এনে মেঘ তৈরি করল।
কিন্তু দখিনাও টেকেনি। রবিবার তার জায়গা নিয়েছে পুবালি।
মানে পূর্ব দিক থেকে আসা বাতাস। বায়ুপ্রবাহের এ হেন পরিবর্তনে মেঘ নেমে এসেছে মাটির কাছে। ঘন মেঘে সূর্য মুখ ঢাকায় এ দিন দুপুর পর্যন্ত ভেজা শীতের ভাব, কোথাও বা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দিনের বেলা ‘নকল’ শীতের আমেজ। যদিও রাতে তাপমাত্রা তেমন নামেনি। আলিপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ দিন কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা কিনা স্বাভাবিকের দু’ডিগ্রি বেশি! ফলে দিন ফুরোতেই আমেজটা উধাও। |
অর্থাৎ চলতি মরসুমের গোড়া থেকে বঙ্গের শীতের সামনে যে দেওয়াল খাড়া রয়েছে, এ বারও তা অটুট। নিজের ছন্দে ফেরার আগে হাওয়া-বদলের জেরে থমকে গেল উত্তুরে বাতাস। বায়ুপ্রবাহ এমন অস্থিরমতি কেন?
আবহবিদদের ব্যাখ্যা: উত্তর ভারত থেকে যেমন পশ্চিমী ঝঞ্ঝা সরাসরি পূর্ব ভারতে বয়ে আসছে, তেমন বঙ্গোপসাগর থেকে আসা পুবালির চরিত্রেও পরিবর্তন ধরা পড়েছে। দুইয়ে মিলে এ রাজ্যে থমকে গিয়েছে শীতের রথ। দিল্লির মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীদের মতে, জুন থেকে নভেম্বর ইস্তক ঘন ঘন দানা বাঁধা ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বঙ্গোপসাগর এলাকার বায়ুপ্রবাহ থিতু হতে পারেনি। তারই প্রভাব পড়ছে বঙ্গোপসাগরের স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহে। তামিলনাড়ু-অন্ধ্র থেকে পুবালি বাতাসের পথ ভুলে বাংলায় হাজির হওয়া তারই প্রমাণ বলে ওঁদের দাবি।
বিশ্ব জুড়েই এখন অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। কোথাও তুষারঝড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত। কোথাও গরমে হাসফাঁস। কোথাও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৪০ ডিগ্রি (আমেরিকার শিকাগো) নীচে, কোথাও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৭-৮ ডিগ্রি উপরে (ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো)! ব্রিটেনে আবার প্রাণ ওষ্ঠাগত ঝড়-বৃষ্টিতে। পরিবেশবিদদের মত, বঙ্গোপসাগরের মতো মেরু অঞ্চলেও ঘূর্ণাবর্তের চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। তাতেই আমেরিকায় যেন তুষারযুগের প্রত্যাবর্তন। অন্য দিকে অতলান্তিকের আবহাওয়া পাল্টে গিয়েই ব্রিটেনে ঝড়-জলের দাপাদাপি। বিশ্ব উষ্ণায়নের দরুণ অতলান্তিকে ঘূর্ণিঝড়ের বাড়বাড়ন্তের আগাম ইঙ্গিত রয়েছে ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টেও।
পাশাপাশি ভারতেও শীতের মতিগতিতে ঘোর অস্বাভাবিকতা। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে কোথাও কোথাও শৈত্যপ্রবাহ। অথচ
পূর্বাঞ্চলে ঠান্ডা নেই। এর পিছনেও বিশ্ব উষ্ণায়নের ভূমিকা দেখছেন পরিবেশবিদেরা। তবে আবহ-বিজ্ঞানীরা এখনই সে তত্ত্ব পুরোপুরি মানতে নারাজ। দেখা যাক, পশ্চিমবঙ্গে এ বারের শীত কতটা অস্বাভাবিক।
তথ্য বলছে, ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি ইস্তক রাজ্য শৈত্যপ্রবাহের মুখ দেখেছে সাকুল্যে এক বার। তা-ও শুধু একটি জেলায় (বীরভূম), স্রেফ এক দিনের জন্য। অথচ আগে বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মতো পশ্চিমী জেলায় শীতকালে শৈত্যপ্রবাহ বয়েছে, খাস কলকাতাতেও তাপমাত্রা নেমেছে দশ ডিগ্রিতে। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী, গত দশ বছরে জানুয়ারিতে কলকাতায় থার্মোমিটারের পারদ ১০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে চার-চার বার। গত বছরের জানুয়ারিতে শীতের দৌড়ে কলকাতা লন্ডনকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। এ বার এমন কেন?
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে আবহ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শীতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া (পশ্চিমী ঝঞ্ঝা) পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে কাশ্মীরে ঢুকে বৃষ্টি-তুষারপাত ঘটায়। তাতে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে ঠান্ডা পড়ে। সেখানকার শীতল বাতাসই বয়ে আসে বাংলায়, আমজনতার কাছে যার নাম উত্তুরে হাওয়া। “তবে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা কখনও পথ পাল্টে সরাসরি পূর্ব ভারতে হাজির হয়। তাতে উত্তুরে হাওয়ার গতি আটকে যায়।” বলছেন কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানী। চলতি মরসুমে যেমনটা হচ্ছে। পাশাপাশি শীতকালে যে পুবালি বাতাসের আধিপত্য অন্ধ্র-সহ দক্ষিণ ভারতে ঠান্ডা মালুম হতে দেয় না, তারও ছোঁয়াচ লেগেছে পশ্চিমবঙ্গে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (জলবায়ুবিদ্যা) বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “এ বার পূবালি বাতাস কিছুটা উত্তরে (বাংলার দিকে) সরে এসেছে।”
পরিণামে সাঁড়াশি চাপের মুখে পিছু হটছে বঙ্গের শীত। এ কি স্থায়ী পরিবর্তন? মৌসম ভবন নিশ্চিত নয়। তবে আবহ-বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, ভারতের শীতের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার আবহাওয়ার যোগাযোগ রয়েছে। গত বছর যেমন ওখানে বায়ুপ্রবাহের বদল ঘটায় ঘন ঘন পশ্চিমী ঝঞ্ঝা আছড়ে পড়েছিল কাশ্মীরে। “জলবায়ুর বদল এক বারে ঘটে না। নানা পরিবর্তনের মধ্যে তার ইঙ্গিত মেলে। দেখতে হবে, এখানেও তা-ই হচ্ছে কি না। এ জন্য গভীর গবেষণা জরুরি।” বলছেন ওঁদের এক জন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক লক্ষ্মীনারায়ণ শতপথী আবহাওয়াজনিত কারণের পাশাপাশি দায়ী করছেন দূষণকেও। তাঁর দাবি, “বাতাসে ভাসমান কণার (এরোসল) জন্যও শীত কমছে।”
আলিপুরের পূর্বাভাস, আজ সোমবার তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু তা ক’দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
অর্থাৎ তত্ত্ব যা-ই হোক, বঙ্গবাসীর শীত-কপালে আপাতত শিকে ছেঁড়ার সম্ভাবনা কম। |