|
|
|
|
নীললোহিত, দিকশূন্যপুর আর নিয়তির হাসি |
আপনার কল্পনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। কিন্তু নীললোহিতের যাত্রার
সঙ্গী হতেই পারেন এ ছবিতে। লিখছেন সংযুক্তা বসু। |
নীললোহিত আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নীললোহিতকে তো তার স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই কোনও দিন ধরে রাখতে পারেননি। সুনীলের কখনও কখনও নীললোহিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে অজানা কোনও স্টেশনে, কখনও বা কাটা ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনও তেপান্তরের মাঠে, কখনও বা অনাহূত নিমন্ত্রিতের বেশে বিয়েবাড়িতে। আবার কখনও কোনও গানের জলসায়, বা এক্কেবারে সোজা গিয়ে সাহেব-মেমদের দেশে। তার পর নীললোহিত আবার মিলিয়ে গিয়েছে তার দিকশূন্যপুরে।
এই রকম যুবক যার বয়স কখনও সাতাশ ছাড়ায় না, সুনীলের কাকাবাবুর পর এ বার সেই নীললোহিতকেই বড় পর্দায় ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক বিষ্ণু পাল চৌধুরী। সেই বিষ্ণু পাল চৌধুরী যিনি মূলত ‘জননী’ সিরিয়াল করেই বিখ্যাত।
এর আগে একটা ছবি করেছিলেন বিষ্ণু। সে ছবি চলেনি। কিছু লোকের যদিও ছবিটা ভাল লেগেছিল।
সুনীলের নীললোহিত সিরিজের এই গল্পের নাম ‘নিয়তির মুচকি হাসি।’ যেখানে নীললোহিত নিয়তি দেবী নামে তার ‘ডেসটিনি’র পাশার চালে বিপর্যস্ত হয়, বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু নিজের পছন্দমতো পথেই চলতে থাকে। সে নিয়তির মুচকি হাসির ধার ধারে না। নিজের পাশার চাল নিজেই দেয়।
দর্শকের মনে একটাই প্রশ্ন উঠতে পারে এই চিরতরুণ, ভবঘুরে বাঙালি আইকনকে বিষ্ণু সত্যিই পর্দায় আঁকতে পারবেন তো? এর উত্তরে বলা যায় পরিচালক নীললোহিতকে অর্ধেক এঁকেছেন, বাকি অর্ধেক যে নীললোহিত শুধুই কিছু অনুভূতির আবছা আদল, তাকে পরিচালক আঁকেননি।
দার্জিলিং ফেরত ট্রেন লেট করায় নীললোহিত নেমে পড়ে এক অজানা স্টেশনে। পৌঁছে যায় মল্লিকপুর গ্রামে। আর সেখানেই এক পরিবারের আত্মীয় হয়ে ওঠে সে। তাকে সেই গ্রামের ভট্টাচার্যি বাড়ির হারিয়ে যাওয়া নীলু বলে ভ্রম হয় সকলের। পরিস্থিতির এই নীলমণির ভূমিকাতেই অভিনয় করতে আরম্ভ করে নীললোহিত নানা রকম ঠোক্কর খেতে খেতে। |
|
গল্পের প্রথমাধ্বের্র্ পাঠকের মনে যে নীললোহিত আঁকা আছে তার সঙ্গে কিছুতেই যেন মেলে না সিনেমার নীললোহিত। কী করেই বা মিলবে? গল্পকে পুরোপুরি অনুসরণের দিকে মন দিয়েছেন পরিচালক। সেখানে নিজের নীললোহিত চেতনাকে সিনেমাটিক করতে চাননি। নিত্য-দিনের ঘটে যাওয়া পার্থিব কিছু ঘটনার আনাচকানাচ থেকেই যে নীলু অনেক বড়, মহৎ জীবনের সঙ্গে সেতু বাঁধে। তাই নীললোহিত নামটার সঙ্গে যে প্যাশন জড়িয়ে আছে রোমা্যন্টিক বাঙালির, তা প্রথমার্ধ্বে কেবল প্রতীক্ষাতেই থাকে। বরং দ্বিতীয় পর্বটা সেই তুলনায় লিরিক্যাল।
গল্প যত এগোয়, খানিকটা বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে নীললোহিতের ভূমিকায় সমদর্শী দত্ত। দর্শক খুব ধীরে ধীরে নানা ঘটনাবর্তের মধ্যে দিয়ে নীললোহিতের জীবনে ঘটে চলা নাটকের মধ্যে ঢুকতে আরম্ভ করতে পারেন। বীরভূমের গ্রামের পটভূমি বেশ মনোরম ঠিক যেমনটা পাওয়া যায় বইতেও।
বাংলার গ্রামের নিসর্গের মধ্যে মাঝে মাঝেই নীললোহিতের হারিয়ে যাওয়া হঠাৎ হঠাৎ খোঁজ দেয় এক টুকরো দিকশূন্যপুরের। নীললোহিত যেখানে যেতে চায় বিন্তিকে নিয়ে।
বিন্তি এই গল্পের নায়িকা, যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ভট্টাচার্যি বাড়ির নীলমণির। কিন্তু সে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় বিন্তিকে বিয়ে করার চাপ এসে পড়ে নীললোহিতের ওপর। তার কারণ বিন্তিকে বিয়ে করলে ভট্টাচার্যি পরিবার যৌতুক হিসেবে পেয়ে যাবে তাদের হারানো আমবাগান। যে আমবাগান নাকি বিক্রি করে ইটভাটা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।
বিষ্ণু ছবি করার ছলে আমবাগানের রূপক এনে ‘প্রকৃতি বাঁচাও’য়ের একটা সমসাময়িক প্রসঙ্গ এনেছেন যেটা ছবির মধ্যে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করে। গ্রামের প্রান্তর দিয়ে নীললোহিত আর বিন্তির হেঁটে আসা, তাঁতি পাড়ায় নীললোহিতের বেড়াতে যাওয়া, গল্পের প্রথমে লং শটে ধীর পায়ে নীলুর আর্বিভাব দৃশ্য দর্শকদের ভাল লাগতে পারে। এই ছবিতে নিয়তি দেবী বারবার এসে দাঁড়ায় নীললোহিতের সামনে। আর কেউ তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু নীললোহিত দেখতে পায়। ‘নিয়তির মুচকি হাসি’ যখন মুচকি হাসিই, তখন পরিচালক তাকে অট্টহাসির চেহারা না দিলেই পারতেন। নিয়তির উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই অতিনাটকীয়। সুনীল এই নিয়তিকে এঁকেছেন একটি অত্যন্ত নিভৃত চরিত্র হিসেবে। যার নাগাল নীললোহিতই পায় না, তো পরিচালকের ক্যামেরা এত স্পষ্ট করে কী ভাবে পাবে? অন্য দিকে বিন্তি ওরফে ঝিলিক ভট্টাচার্যের অতি সাধারণ চেহারা ও মোলায়েম অভিনয় এই ছবিতে একটা রোম্যান্টিক মাত্রা যোগ করে। বিশেষ করে যখন সে গ্রামের পথঘাটে একা একা ঘুরে বেড়ায় আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’ গানটা।
সমদর্শীর এলোমেলো চুল, চোখে চশমা, হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ভবঘুরে দৃষ্টি সব মিলিয়ে নীললোহিতের বাঙালি কল্পনার সঙ্গে ভালই মানিয়ে গিয়েছে। ভট্টাচার্যি বাড়ির সদস্যদের মধ্যে আলাদা ভাবে নজর কাড়ে নীলমণির অশীতিপর বাবার চরিত্রে মনু মুখোপাধ্যায়। বৌদির চরিত্রে বেশ মানানসই কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
“সে খেলবে আমার সাথে খেলনাবাড়ি
চলে দিকশূণ্যপুর আমার এক্কাগাড়ি”
নীললোহিতের স্বপ্নদৃশ্যে বিবস্বান পাল চৌধুরীর লেখা এই গান বেশ কাব্যিক। যাঁরা নীললোহিত পড়েছেন তাঁদের মনে অনেক নেতিবাচক প্রশ্ন উঠতে পারে, নীললোহিত তাঁদের কল্পনার সঙ্গে মিলল কি মিলল না তা নিয়ে। কিন্তু আজকের প্রজন্মের হয়তো অনেকেই সুনীলের এই যাযাবর সাহিত্য পড়েননি। তাঁদের কেমন লাগবে এই ছবি সেটাই দেখার। গল্পের নাম ‘নিয়তির মুচকি হাসি’। কিন্তু পরিচালক ছবির নাম রেখেছেন ‘নীললোহিত’ যেহেতু সে-ই গল্পের মুখ্য চরিত্র।
এই রকম দ্রুত ব্যস্ততার যুগে দাঁড়িয়ে এক বার অন্তত নীললোহিতের যাত্রায় সঙ্গী হওয়াই যেতে পারে। দিকশূন্যপুরের ঠিকানা নাই বা পেলেন। থাকুন না নীললোহিত ধরাছোঁয়ার বাইরে।
|
|
|
|
|
|