ডাক্তার, বিশেষ করে অ্যানেস্থেটিস্টদের একাংশের প্রতিবাদ ও মামলার জেরে সাধারণ এমবিবিএস পাশ মেডিক্যাল অফিসারদের ৬ মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে অ্যানেস্থেটিস্টের কাজ করানোর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গিয়েছিল। সেটা বছর দু’য়েক আগের কথা। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (এনআরএইচএম) টাকায় শুরু হওয়া সেই প্রকল্প খাতায়-কলমে থেকে গেলেও তাতে আর কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। কিন্তু কেন্দ্রের সেই ব্যর্থতা সত্ত্বেও এ বার একই পথে হাঁটতে চলেছে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি এক বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজ্যে অ্যানেস্থেটিস্ট তৈরির নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা।
নবান্ন থেকে সবুজ সঙ্কেতও মিলে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যের ১৩টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০টি করে আসনে আগ্রহী মেডিক্যাল অফিসারদের ‘অবস্টেট্রিক অ্যানেস্থেশিয়া’-র প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অর্থাৎ এই প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা শুধু সিজারের সময় আসন্ন প্রসূতিকে অজ্ঞান করার কাজ করবেন। প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম তৈরি করে ফেলেছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও অ্যানেস্থেটিস্টদের নিয়ে গঠিত স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ কোর কমিটি।
যাঁরা পাশ করবেন তাঁদের ‘অবস্টেট্রিক অ্যানেস্থেশিয়া’য় ফেলোশিপ দেবে রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়। জুন মাসের আগেই প্রশিক্ষণপর্ব শুরু হবে। এক বছর পর পাশ করলে প্রথম দফায় রাজ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসব হয় (বছরে ১০ হাজারের বেশি) এমন ১৩টি কেন্দ্রে তাঁদের পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন মা ও শিশুর মৃত্যু রুখতে গঠিত স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ১৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ন্যাশনাল মেডিক্যাল, নীলরতন সরকার হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন সেবাসদন, আরজিকর, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, সিউড়ি-পুরুলিয়া-কৃষ্ণনগর হাসপাতাল, বর্ধমান-বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-মালদহ-মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে।
ত্রিদিববাবুর কথায়, “রাজ্যে অ্যানেস্থেটিস্ট খুব কম। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য, জেলায় ধাপে-ধাপে প্রায় সাড়ে তিনশো ডেলিভারি পয়েন্ট খোলা। কারণ, একটা সিজারের জন্য অনেক জায়গায় গ্রামের প্রসূতিকে বহু দূর আসতে হয়। তাতে মা ও শিশু দু’জনের প্রাণের আশঙ্কা থাকে। সিজার অ্যানেস্থেটিস্ট ছাড়া হবে না। তাই ফেলোশিপ দিয়ে প্রতি বছর সিজারের জন্য ১৩০ জন করে অ্যানেস্থেটিস্ট তৈরির কথা ভাবা হয়েছে।”
কিন্তু সমালোচনা এই প্রকল্পেরও পিছু নিয়েছে। যেমন অ্যানেস্থেটিস্টদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ অ্যানেস্থেশিওলজি’-র সদস্যদের বক্তব্য, সিজারের অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া সবচেয়ে কঠিন। কারণ এখানে কোনও অসুস্থ মানুষকে নয়, সুস্থ মানুষকে অজ্ঞান করা হচ্ছে। তার উপর, মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর স্বাস্থ্যও জড়িয়ে আছে। ওষুধের সামান্য হেরফেরে সেই শিশুর চরম ক্ষতি হতে পারে। এটা শিখতে গেলে অগাধ অভিজ্ঞতা, ওষুধ ও রোগ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। এক বছরের প্রশিক্ষণে সেটা কতটা সম্ভব সরকার ভেবে দেখুক। সংগঠনের মুখ্য নির্বাচনী কর্তা তথা সদ্যপ্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অঞ্জন দত্তের মতে, “এই ভাবে প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম সাজাতে হবে যাতে এক বছর টানা প্রায় প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে ডিউটি করতে হয়। তা না হলে চিকিৎসকেরা আত্মবিশ্বাস পাবেন না।”
সঠিক প্রশিক্ষণ না পেলে প্রশিক্ষিত অ্যানেস্থেটিস্টরা কাজের সাহস পাবেন না বলে মেনেছেন রাজ্যের অবস্টেট্রিক মেন্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য চিকিৎসক দেবাশিস ভট্টাচার্যও। বছর দু’য়েক আগে এনআরএইচএমের টাকায় রাজ্যে ১৪০ জন মেডিক্যাল অফিসারকে ৬ মাসের অ্যানেস্থেশিয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বেশিরভাগ ভয়ের চোটে কোনও অস্ত্রোপচার করতেই পারেননি বলে জানিয়েছেন দেবাশিসবাবু।
যেমন, প্রশ্ন উঠেছে, মেডিক্যাল অফিসারেরা এই পাঠ্যক্রমে যোগ দেবেন কেন? শুধুশুধু বাড়তি চাপ নেবেন কেন? ত্রিদিববাবুর জবাব, “ফেলোশিপ পেতে অবশ্যই। এ ছাড়া, পরবর্তীকালে স্নাতকোত্তরের পরীক্ষায় তাঁদের নম্বর কিছু বাড়ানো যায় কি না সেই চিন্তাও করা হচ্ছে।” কিন্তু প্রশিক্ষণটুকু নিয়ে, নিজের বায়োডেটায় ফেলোশিপ জুড়েই যদি কোনও মেডিক্যাল অফিসার সিজার করতে না চান তখন? ত্রিদিববাবুর উত্তর, “এর জন্য আমরা একটা বন্ডের কথা ভাবছি। বন্ড দিয়ে তবে জেলায় যেতে হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের । দায়িত্ব পালন না করলে জরিমানা বা অন্য শাস্তি হবে।” কিন্তু বন্ডের কথা শুনে অনেকে ফেলোশিপ প্রকল্পে আগ্রহ দেখাবেন না এমন আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আবার যে সব মেডিক্যাল অফিসারকে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এই ফেলোশিপের জন্য বাছাই করে তুলে আনা হবে তাঁদের জায়গায় নতুন ডাক্তার দিতে হবে। চিকিৎসকের আকালের এই বাজারে সে ব্যাপারেও চাপমুক্ত থাকতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা। |