ভারতে তৈরি নানা ধরনের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ ভাবে ভারতীয় সেনা, আধা-সামরিক বাহিনী আর পুলিশেরই ব্যবহার করার কথা। কিন্তু দেশীয় কারখানায় তৈরি ইনস্যাস, এসএলআর-এর মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেল প্রচুর পরিমাণে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-এর হাতেও পৌঁছে গিয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরির মালমশলা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশল যে কেএলও-র হস্তগত হয়েছে, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ডিসেম্বরের শেষে জলপাইগুড়িতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার প্রমাণও দিয়েছে তারা। কিন্তু বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় রাইফেল কেএলও-র হাতে আসাটা তার চেয়ে কিছু কম বিপজ্জনক বলে মনে করছেন না গোয়েন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, ওই সব আধুনিক অস্ত্র পেয়ে কেএলও এ বার রাজ্যের মন্ত্রী বা শাসক দলের নেতাদের উপরে হামলা চালানোর ব্যাপারে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন উঠছে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর উপরে হামলা চালিয়ে বহু আগ্নেয়াস্ত্র লুঠ করেছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে কেএলও-র তো তেমন হামলার নজির নেই। তা হলে ইছাপুর রাইফেল কারখানার মতো দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে তৈরি ইনস্যাস, এসএলআর-এর মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেল কী করে পেল কেএলও?
এ ক্ষেত্রে নেপালের মাওবাদীদের হাত দেখছে রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি)। তাদের দাবি, ভারতের ওই সব অস্ত্র নেপাল হয়ে কেএলও-র হাতে পৌঁছেছে। ২০১৩ সালে ইউনিফায়েড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী)-এর সঙ্গে ১৫ কোটি টাকার চুক্তি করার ফলে কেএলও ওই সব স্বয়ংক্রিয় রাইফেল পেয়েছে। কারণ, এক সময় ভারত ৬০ হাজার এসএলআর এবং ৪০ হাজার ইনস্যাস রাইফেল বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করেছিল নেপালের সেনাবাহিনীকে। পরে অবশ্য নেপালের সেনা মার্কিন এম-১৬, জার্মান হেকলার অ্যান্ড কক এমপি-৫, ইজরায়েলে তৈরি আইএমআই গালিল এবং ব্রিটেনের স্টার্লিং সাবমেশিনগানের মতো আরও উন্নত ও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে যায়। ফলে তখন ইনস্যাস এবং এসএলআর-এর মতো ভারতে তৈরি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নেপাল পুলিশের বিশেষ ইউনিট এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
গোয়েন্দাদের ধারণা, সেই সময়েই ভারতে তৈরি ওই অস্ত্রসম্ভারের একটা বড় অংশ কোনও ভাবে নেপালের মাওবাদীদের হাতে চলে যায়। তাদের সঙ্গে চুক্তির সুবাদে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু ইনস্যাস এবং এসএলআর পেয়ে যায় কেএলও। নেপালে মাওবাদীরা ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে। আইবি-র বক্তব্য, কেএলও-র সঙ্গে অস্ত্রচুক্তির ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
ভারতে তৈরি সেই সব অস্ত্র নেপাল ঘুরে আসার পরে এ দেশেই নাশকতামূলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২৮ ডিসেম্বর মালদহের বামনগোলার কালিকাপুরে একটি বাসে কেএলও জঙ্গিদের হামলায় এসএলআর থেকেই যে গুলি চালানো হয়েছিল, ঘটনাস্থলে পাওয়া খালি কার্তুজ তার প্রমাণ বলে পুলিশের অভিমত। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “এসএলআর-এর পাল্লা প্রায় ৬০০ মিটার এবং ইনস্যাসের পাল্লা প্রায় ৫০০ মিটার। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহের মতো জেলায় মন্ত্রী বা নেতার গাড়িতে হামলা চালাতে হলে ওই রাইফেলের জুড়ি নেই। ওই সব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দূর থেকে হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া কোনও সমস্যাই নয়। জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী এক রকম গিজগিজ করছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গে তেমন সুরক্ষার বন্দোবস্ত নেই।”
ওই অফিসারের বক্তব্য, কেএলও জঙ্গিরা আইইডি তৈরি ও ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করলেও মাওবাদীদের মতো আইইডি দিয়ে ল্যান্ডমাইন তৈরির প্রযুক্তি এখনও শিখতে পারেনি। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে হানার মাধ্যমে তারা সেই সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করতে পারে। মালদহের ঘটনা মহড়া মাত্র। নেতা-মন্ত্রীরাই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের আসল লক্ষ্য বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেএলও তাদের কার্যকলাপের প্রথম দফায় অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে ২০০৩-’০৪ পর্যন্ত গুপ্তহত্যার ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে রিভলভার বা পিস্তলই ব্যবহার করত। তবে ২০০২-এর ১৭ অগস্ট জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে সিপিএমের পার্টি অফিসে হামলায় একে-৪৭ থেকে গুলি চালিয়ে পাঁচ জনকে হত্যা করা হয়। কেএলও-র বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান জয়দেব রায় ওরফে টম অধিকারী গুলি চালান বলে অভিযোগ। তবে সেটা ছিল আলফা ও কেএলও-র যৌথ হানা। কেএলও একা যেখানে হামলা চালিয়েছে, সেই সব ঘটনায় তখন স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হত না বললেই চলে।
কিন্তু ২০১২-র ১৩ নভেম্বর অসমের ধুবুরির তিন জায়গায় দুই কেএলও জঙ্গি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে এলোপাথাড়ি ৫০ রাউন্ড গুলি চালায়। তা থেকেই পুলিশ বুঝে যায়, কেএলও জঙ্গিরা ওই অস্ত্র ব্যবহারের পথ নিয়েছে। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “কেএলও-র সাংগঠনিক সম্পাদক মাধব মণ্ডল ওরফে মালখান সিংহ দু’হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল চালাতে পটু। মায়ানমারের হাকহার জঙ্গলে কেএলও-র বহু জঙ্গি ওই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছে।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “কেএলও যে প্রচুর স্বয়ংক্রিয় রাইফেল পেয়েছে, পুলিশ-প্রশাসন সেটা জানতে পেরেছে। এই অবস্থায় উত্তরবঙ্গের পুলিশের আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। সেই কাজ শুরু হয়েছে। তবে কিছুটা সময় লাগবে।” |