তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছিল এক কিশোরী। তখনও তার গায়ে আগুন জ্বলছে। কিন্তু খানিকটা নেমেই দোতলার ল্যান্ডিংয়ে পড়ে যায় সে। তার চিৎকার শুনে ততক্ষণে চলে এসেছেন আশপাশের বাসিন্দারা। গায়ে জল ঢেলে, বস্তা চাপা দিয়ে তাঁরা মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আগুন নেভার পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো গেল না ওই কিশোরীকে। গায়ে আগুন লেগে মৃত্যুর এমনই বর্ণনা পাওয়া গেল কিশোরী ওই পরিচারিকা যে বহুতলে কাজ করত, সেখানকার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে।
কাজের খোঁজে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে কলকাতায় কাজে এসেছিল তেরো বছরের তপতী দাস। কিন্তু এর সাত মাসের মধ্যেই আগুনে পুড়ে মৃত্যু হল তার। বুধবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে দমদম থানা এলাকার বেদিয়াপাড়ায়। অভিযোগ উঠেছে, যে বাড়িতে সে পরিচারিকার কাজ করত, সেই বাড়িরই গৃহকর্ত্রী, মেয়ে ও জামাই মিলে তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছেন। পুলিশের কাছে লিখিত এই অভিযোগ করেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। তার ভিত্তিতে গৃহকর্ত্রী সীমা গুপ্ত, তাঁর মেয়ে সাগ্নিকা দে ও জামাই শিবাজী দে-কে গ্রেফতার করে পুলিশ। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান দেবাশিস বেজ বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা শুরু হয়েছে। তদন্ত চলছে।” বৃহস্পতিবার ব্যারাকপুর আদালতে ধৃতদের চার দিনের পুলিশি হেফাজত দেওয়া হয়। যদিও অভিযুক্তদের দাবি, তাঁরা কিছুই জানতেন না। তপতী নিজে বাথরুমে ঢুকে গায়ে আগুন দেয়। পরে জানতে পারেন তাঁরা।
বেদিয়াপাড়ার ওই বহুতলের বাসিন্দারা জানান, ওই রাতে তপতীর চিৎকার শুনতে পেয়ে ছুটে আসেন তাঁরা। চলে আসেন বহুতলের পিছনে চাষিপাড়ার বাসিন্দারাও। গীতা দাস নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “চিৎকার শুনে গিয়ে দেখি মেয়েটির বুক থেকে মাথা এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে চেনা যাচ্ছে না।” ঘটনার সময়ে সীমাদেবীরাও বেরিয়ে আসেন। তপতীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে জনরোষ গিয়ে পড়ে তাঁদের উপর। স্থানীয়েরা ঘরে ঢুকে দেখেন বাথরুমে পোড়া চিহ্ন। শুরু হয় ভাঙচুর। সীমাদেবীরা যাতে পালাতে না পারেন, তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফ্ল্যাটের দরজা। খবর যায় পুলিশে।
বেদিয়াপাড়ায় শান্ত মেয়ে বলেই পরিচিত ছিল তপতী। তার ডাক নাম ছিল ঝিলিক। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, কাজে ঢোকার মাস খানেক পর থেকেই তপতীর উপর শারীরিক নিগ্রহ করা হত। তপতীই তাঁদের এ কথা জানান বলে দাবি করেন কয়েকজন প্রতিবেশী। তার এক বন্ধু গুড়িয়া শর্মা বলে, “ওর লম্বা চুল জোর করে কেটে দিয়েছিল ওঁরা। আমাকে অনেকবার বলেছে, কাজে ভুল করলে বা দেরি করলে স্কেল ও লাঠি দিয়ে মারা হত। দোকানে গিয়ে ফিরতে দেরি হলেও মারধর করা হত। বুধবার ও আমাকে বলে কাউন্সিলরকে বিষয়টা জানাতে চাই।” প্রতিবেশীরা জানান, রাতে তপতী যখন পাড়ার একটি মুদিখানায় যায়, তখন ওর মুখে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাঁরা আরও জানান, বুধবার রাত ন’টা থেকে ওই বাড়িতে চেঁচামেচি হচ্ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, ওই কিশোরীর উপর যে এ রকম নির্যাতন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে তা জেনেও কেন চুপ ছিলেন বাসিন্দারা। কেনই বা তাঁরা উদ্যোগী হয়ে কাউন্সিলর বা পুলিশকে জানাননি। এর উত্তর অবশ্য মেলেনি। তপতীর উপর শুধু কাজে ভুল করার জন্য না অন্য কারণে অত্যাচার হত, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তার উপর কোনও যৌন নির্যাতন হত কি না, সে বিষয়েও তদন্ত করছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আগেও বেদিয়াপাড়ার একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত তপতী। সেখানেও তাকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এই অভিযোগ গিয়েছিল স্থানীয় সিপিএম কাউন্সিলর তপতী বর্মণের কাছে। তিনি বলেন, “স্থানীয়রাই মেয়েটিকে আমার কাছে নিয়ে আসে। সেই সময় সীমাদেবী জানান তাঁর বাড়িতে ঘরের কাজ করার একজন দরকার। মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতো রাখবেন। দমদম থানায় সব জানিয়ে তপতীকে ওই পরিবারের হাতে দিই।” তার পর অবশ্য মেয়েটির খোঁজ করেননি তিনি। তপতীদেবী বলেন, “মাঝেমধ্যে খোঁজ করা উচিত ছিল। নানা কাজের চাপে করা হয়নি। মেয়েটির উপর যে শারীরিক নিগ্রহ হত, জানতাম না। জানলে ব্যবস্থা নিতাম।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, সীমাদেবীর বাড়িতে গত ছ’মাস ধরে পরিচারিকার কাজ করছিল তপতী। বেদিয়াপাড়ার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোডে সূচনা অ্যপার্টমেন্ট নামে ওই বহুতলের তিন তলায় শিবাজী তাঁর স্ত্রী, শাশুড়ি ছাড়াও থাকতেন সীমাদেবীর বৃদ্ধ মা-বাবাও। সাগ্নিকা ও তাঁর স্বামী পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ধর্মতলার চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালে তাদের অফিস। ঘটনার সময় সবাই বাড়িতে ছিলেন বলে জেনেছে পুলিশ।
এ দিকে খবর পেয়ে ছুটে আসেন তপতীর এক কাকা গৌতম দাস। তপতীর মা-বাবা নেই। দাঁতনের বাড়িতে তাঁর নিজের বলতে সৎ মা ও কিছু আত্মীয়। গৌতমবাবু বলেন, “চাষবাস করি। বাড়িতে সবসময় অভাব অনটন। ভেবেছিলাম শহরে গিয়ে মেয়েটি খেয়ে-পরে বাঁচবে। তাই কলকাতায় পাঠাই। কিন্তু এ ভাবে ওঁরা মেয়েটাকে মেরে ফেলবে, ভাবতে পারনি।”
|