দেশের শিল্প মহলের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দু’দশকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কখনও কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে। কখনও আবার বণিকসভা ফিকি-র সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে। রাজ্যের শিল্প দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে বৃহস্পতিবার প্রথম কোনও বণিকসভার অনুষ্ঠানে এসে সেই পরিচয়কেই পুরোদস্তুর কাজে লাগালেন অমিত মিত্র। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি শিল্পমহলের কাছের লোক। একই সঙ্গে একেবারে কর্পোরেট কায়দায় ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন’-এর মাধ্যমে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে রাজ্যকে বিপণন করলেন লগ্নিকারীদের সামনে।
দেশের প্রাচীনতম বণিকসভা বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স এবং অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি ও শিল্পকর্তাদের সংগঠন নন রেসিডেন্ট ওভারসিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল বৃহস্পতিবার একটি শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। ‘বিজনেস অ্যাট বেঙ্গল’ শীর্ষক এই সম্মেলনের প্রধান বক্তা ছিলেন অমিত মিত্র। সেখানে গোড়াতেই শিল্পমহলের সঙ্গে তাঁর পুরনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেন অমিতবাবু। বলেন বেঙ্গল চেম্বারের বর্তমান প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত ও ভাইস প্রেসিডেন্ট অম্বরীশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। পাশাপাশি এই অনুষ্ঠান নিয়ে নিজের আগ্রহ বোঝাতে জানিয়ে দেন, নিজেই তিন-তিন বার সরাসরি ফোন করেছেন কল্লোলবাবুকে। “এ ভাবেই আমাদের সরকার চলে,” মন্তব্য অমিতবাবুর। |
বস্তুত, রাজ্য সরকার যে লগ্নিকারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে, সে কথা এ দিন নিজের বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিতবাবু। শিল্প প্রস্তাব আসার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়া এবং বিভিন্ন দফতরের কাছ থেকে ছাড়পত্র আদায়ে লগ্নিকারীদের যাতে সমস্যা না-হয়, সে জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজার নিয়োগের কথা আগেই ঘোষণা করেছে রাজ্য। অমিতবাবু এ দিন জানান, পাঁচটি বড় প্রকল্পের জন্য পাঁচ জন ম্যানেজার ইতিমধ্যেই নিয়োগ করা হয়েছে। যাঁরা লগ্নিকারীদের সঙ্গে সরাসরি সরকারের যোগসূত্র।
বিনিয়োগ করার জন্য যে সব শর্ত পূরণের দিকে তাকিয়ে থাকেন শিল্পপতিরা, সে সব ক্ষেত্রেই রাজ্য দ্রুত এগোচ্ছে বলে এ দিন দাবি করেছেন নতুন শিল্পমন্ত্রী। যেমন, শ্রম, শিক্ষা, মানবসম্পদ, তথ্যপ্রযুক্তি, সাধারণ অর্থনীতি, আর্থিক বৃদ্ধির হার, এক জানলা ব্যবস্থা ইত্যাদি। নিজেরই হাতে থাকা অর্থ দফতরের সাফল্যের উদাহরণ টেনে বলেছেন, আগের আমলে কোষাগারের যে বেহাল দশা ছিল, এখন তার অনেক উন্নতি হয়েছে। গত বছরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে কর আদায়ের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে।
শিল্পের জন্য দক্ষ কর্মী গড়ার কাজেও সরকার তৎপর বলে দাবি করে অমিতবাবু বলেন, গত আড়াই বছরে রাজ্যে ৫টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিটি ব্লকে আইটিআই এবং প্রতিটি মহকুমায় একটি করে পলিটেকনিক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ কাজে শিল্পমহলের সাহায্য চেয়ে অমিতবাবুর মন্তব্য, “আপনারা সবাই এগিয়ে আসুন। প্রতিটি বণিকসভা কয়েকটি আইটিআই-র দায়িত্ব নিলে দক্ষ কর্মী পেতে অসুবিধা হবে না।”
নতুন শিল্পমন্ত্রীর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগতই জানিয়েছে শিল্পমহল। কল্লোল দত্ত বলেন, “এমনটাই হওয়া উচিত। যে-আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উনি রাজ্যের ইতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরলেন, তা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার করবে।”
কিন্তু বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত যে সব বিষয়ের উপরে নির্ভর করে, সরকারি নীতি তার অন্যতম বলে এ দিনই কবুল করেছেন অমিতবাবু। এবং ইদানীং অন্য অনেক প্রশ্নে বেশ কিছুটা ইতিবাচক হওয়া সত্ত্বেও জমি প্রশ্নে সরকারের অবস্থান নিয়ে যে তাঁদের সংশয় রয়েছে, সে কথা জানাচ্ছেন শিল্পপতিদের একটা বড় অংশ। তাঁদের মতে, সরকার যে ভাবে বেসরকারি শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ না-করার কথা বলেছে, কেন্দ্রের আর্জি সত্ত্বেও শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহারে অনীহা দেখিয়েছে, গ্রামাঞ্চলে সিলিং বহির্ভূত জমিতে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি নিজেদের ইচ্ছাধীন করে রেখেছে সেটা সব অর্থেই লগ্নি টানার পরিপন্থী।
অমিতবাবু অবশ্য এ দিন তাঁর পূর্বসূরির সুরেই ফের দাবি করেছেন, শিল্পের জন্য জমির কোনও অভাব নেই। তাঁর দাবি, রাজ্যের ২৩টি শিল্পতালুকেই ৩ হাজার একরের বেশি জমি রয়েছে। শিল্পপতিদের প্রতি অমিতবাবুর আহ্বান, “আপনারা কালকেই শিল্পতালুকে গিয়ে জমি দেখে আসুন। শিল্পোন্নয়ন নিগম সব ব্যবস্থা করে দেবে।” কিন্তু শিল্পমহলের অনেকেরই বক্তব্য, শিল্পতালুকে যে জমি আছে, তা বড় শিল্প করার উপযুক্ত নয়। ভারী শিল্প করতে গেলে অন্যত্র জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে।
অমিতবাবুর অবশ্য দাবি, রাজ্যের অন্যত্রও বড় শিল্পের জন্য জমির অভাব নেই। যেমন, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে বা পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ে। কিন্তু এই সব জায়গায় শিল্প গড়ার মতো যথেষ্ট পরিকাঠামো আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন লগ্নিকারীদের। যদিও অমিতবাবু এ দিন জানান, শিল্পপতিরা আগ্রহ দেখালে পরিকাঠামো গড়ে দিতে সরকার কোনও রকম কার্পণ্য করবে না।
জমি নীতির প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শিল্প আসবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের ঐকান্তিকতায় শিল্প মহল মোটের উপর সন্তুষ্ট। যার ইঙ্গিত দিয়ে নন রেসিডেন্ট ওভারসিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল-এর সভাপতি নীলাংশু দে যেমন বললেন, “এ বারের সম্মেলনের জন্য লন্ডনকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আগ্রহে সম্মেলন কলকাতায় নিয়ে এসেছি আমরা।” |