লোক আদালতের রায়ের পরে কেটে গিয়েছে পাঁচ বছর। গঙ্গার ভাঙনে দুর্গত মানিকচক ও পঞ্চানন্দপুরে ১৭৫০টি পরিবার আজও পায়নি ঘর তৈরির টাকা। জেলাশাসক থেকে শুরু করে জেলার নানা রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত মালদহের ওই দুর্গত বাসিন্দারা। ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে ইতিমধ্যেই ভাঙন দুর্গত ৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে হাইকোর্টে আবেদনের সাধ্যও নেই ওই পরিবারগুলির।
কলকাতা হাইকোটের একাধিক বিচারপরতিকে নিয়ে গঠিত লোক আদালতের রায়ের পাঁচ বছর পরেও ক্ষতিপূরণের টাকা না মেলায় ভাঙন দুর্গতদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী বলেন, “লোক আদালতের কী নির্দেশ ছিল আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখছি।” জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক সঞ্জীব চাকি বলেন, “লোক আদালতের রায় হাতে পাওয়ার পরে সেই রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে।” গঙ্গা ভাঙনে মালদহের মানিকচক ও পঞ্চানন্দপুর এলাকার কয়েক হাজার পরিবার জমি জমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। যাঁদের এক সময়ে ৫ বিঘা, কারও ১০ বিঘা, কারও ২০ বিঘা জমি ছিল। এখন গঙ্গা ভাঙনে সবর্স্ব খুইয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। সেই ভাঙন দুর্গতদের কেউ আমবাগানে, কেউ বাঁধের উপরে, কেউবা রাস্তার ধারে অস্থায়ী আস্থানা গেড়ে পরিবারকে নিয়ে বাস করছেন।
২০০৬ সালে ভাঙন দুর্গতের একাংশ বাড়ি তৈরির জন্য ক্ষতিপূরণের আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু ভাঙন দুর্গতদের পক্ষে কলকাতায় গিয়ে আইনজীবী রেখে মামলা চালানো সম্ভব নয় দেখে কলকাতা হাইকোর্টের লিগাল সার্ভিসেস কমিটি মালদহে লোক আদালত বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ৩০ এপ্রিল মালদহ কলেজে কলকাতা হাইকোর্টের লিগাল সার্ভিসেস কমিটি কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতিকে মালদহে নিয়ে এনে লোক আদালতের আয়োজন করে। সেখানে হাইকোর্টের বিচারপতিকে নিয়ে একাধিক বেঞ্চ ১৭৫০ জন ভাঙন দুর্গত পরিবারের পক্ষে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, যে প্রত্যেকটি ভাঙন দুর্গত পরিবারকে ঘর বানানোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে রাজ্য সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভাঙন দুর্গত পরিবারে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
মানিকচকের গোপালপুর মৌজার সহবতপুরগ্রামের বাসিন্দা সেনাউল হক বলেন, “আমাদের পাঁচ বিঘা জমি ছিল। বাড়ি ছিল। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা ভাঙনে জমি বাড়িঘর সব গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে। লোক আদালতে বিচারপতি পি এস দত্তের বেঞ্চ আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। ক্ষতিপূরণ পাইনি। বছর খানেক আগে জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দিয়েছিলাম। টাকা পাইনি। গোপালপুর আমবাগানে এখন বাস করছি।” একই কথা বলেছেন উত্তর হুকুমতটোলার দাউদ আলি কিংবা সহবতটোলার বরকত আলিরা।
এতদিন পরেও লোক আদালতের রায়ে ক্ষতিপূরণের টাকা ভাঙন দুর্গতরা পাননি শুনে হতচকিত সেই সময় লোক আদালতের এক বিচারক তথা মালদহ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী অর্চন প্রামাণিক। তিনি বলেন, “এটা ভাবতেই পারছি না, লোক আদালতের রায় মেনে এখনও একজন ভাঙন দুর্গত ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। আমিও লোক আদালতের এক বেঞ্চের বিচারক ছিলাম। আমার পরামর্শ, এখনই ভাঙন দুর্গতরা হাইকোর্টের লিগাল সার্ভিস কমিটির কাছে আবেদন করে বলুন, ‘লোক আদালতের রায় মেনে আমাদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি’।” |