|
|
|
|
সশক্তিকরণ প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে
বঞ্চিত জেলার একাধিক পঞ্চায়েত
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
নিয়ম মেনে কাজ করলেই অতিরিক্ত অর্থ! ওই অর্থে যে কোনও প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারে পঞ্চায়েতগুলি। অর্থের পরিমাণও কম নয়। তৃতীয় অর্থ কমিশন ও ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন মিলিয়ে বছরে যে টাকা পাওয়া যায় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক সশক্তিকরণ কর্মসূচিতে তার থেকেও বেশি টাকা পেতে পারে একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। তবু কেবলমাত্র উদাসীনতার কারণে বছরের পর বছর ধরে এমন সুযোগও গ্রহণ করতে পারেনি বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত। কেউ কেউ আবার দু’-একবার টাকা নেওয়ার পেলেও খরচ না করতে পারায় পরের বছর টাকা পাননি। এমনই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়।
এই প্রকল্পে টাকা না পাওয়ার বড় কারণ হল, পঞ্চায়েতের কাজের গুণগত মান খারাপ। যে পঞ্চায়েত যত ভাল স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছে, মানুষের কাছে উপযুক্ত পরিষেবা পৌঁছে দিতে পেরেছে, সেই পঞ্চায়েতই আরও ভাল কাজ করার জন্য এই প্রকল্পে বরাদ্দ পেয়েছে। অর্থাৎ টাকা না পাওয়ার অর্থই হল পঞ্চায়েতের অগ্রগতি ভাল নয়। এ বার এই সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতই যাতে নিজেদের মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে সে জন্য সচেষ্ট হচ্ছে জেলা প্রশাসন। পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (পঞ্চায়েত) অরিন্দম দত্ত বলেন, “এ বার পঞ্চায়েতের কাজের মান উন্নয়নে বিশেষ নজরদারি চালানো হবে। শীঘ্রই পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকও করা হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে যাতে প্রতিটি পঞ্চায়েতই এই আর্থিক সাহায্য পায়।”
কিন্তু কেন এতদিন তা করা যায়নি? প্রশাসনিক কর্তাদের যুক্তি, দীর্ঘদিন জঙ্গলমহল অশান্ত থাকার কারণে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। সেক্ষেত্রে ওই এলাকার পঞ্চায়েতগুলি উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। আবার প্রশাসনিক কর্তাদেরও জঙ্গলমহলের দিকে নজর থাকার কারণে অন্য দিকে তেমন দৃষ্টি ছিল না। আর দ্বিতীয় যুক্তি হল, রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর পঞ্চায়েতগুলি থেকে গিয়েছিল সিপিএমের হাতেই। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় ও পঞ্চায়েতে বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকায় একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। যে কারণে কাজের গতির ততটা অগ্রগতি ঘটানো যায়নি।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৭২টি গ্রাম পঞ্চায়েত সশক্তিকরণ কর্মসূচির আওতায় এসেছিল। ২০১০-১১ আর্থিক বছর থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম বছরে ১৭২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ৫৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত এই প্রকল্পে অর্থ পেয়েছিল। যেখানে ঝাড়গ্রাম মহকুমার ২৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ১টি গ্রাম পঞ্চায়েত সেই টাকা পায়। ২০১১-১২ আর্থিক বছরে প্রথম ধাপে ৫৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত টাকা পেলেও দ্বিতীয় ধাপে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১১৪ তে। কিন্তু ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ফের তা কমে যায়। মাত্র ১০৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত ওই টাকায় পায়। চলতি আর্থিক বছরে অবশ্য ১৩৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত এই টাকা পেয়েছে। পরের আর্থিক বছরে এই সংখ্যাটা অনেকটাই বাড়বে বলে প্রশাসন আশাবাদী। প্রশাসনিক পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার যে, বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রকল্পের আওতায় থাকলেও অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ, এই অর্থ পেলে নানা ধরনের উন্নয়ন করা যায়। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত কারও জন্য এই অর্থ খরচ করা যায় না। পরিবেশ বান্ধব যে কোনও প্রকল্পই রূপায়ণ করা যায়। এই প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে কেশপুরের শীর্ষা গ্রাম পঞ্চায়েত। পরপর চারবারই টাকা পেয়েছে। বছরে গড়ে টাকা পাওয়ার পরিমাণ ১৮ লক্ষ। তা দিয়ে ২৫টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র তৈরি করেছে, মার্কেট শেড তৈরি করেছে। পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক মিন্টু পালের কথায়, “এই টাকা না পেলে এত কাজ করা আদৌ সম্ভব ছিল না। কারণ, আমরা বছরে বিআরজিএফ, তৃতীয় অর্থ কমিশন বা ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন থেকে বছরে যা টাকা পেয়েছি, এখানে গড়ে তার থেকে বেশি টাকা পেয়েছি। তাই প্রাথমিক স্কুলে চলা, ক্লাবে চলা অঙ্গনওয়াড়ির এখন নিজস্ব বাড়ি হয়েছে।” ডেবরার ষাঁড়পুর-লোয়াদা গ্রাম পঞ্চায়েত ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ আর্থিক বছরে ৩২ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। যা দিয়ে কালভার্ট, রাস্তা, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, নলকূপ, কমিউনিটি হল সহ একাধিক কাজ করেছে। তারপরেই টাকা খরচের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। পঞ্চায়েতের সচিব বাসুদেব পড়্যা বলেন, “এই টাকায় অনেক কাজ করা যায়। যাতে ফের টাকা পায় সে জন্য পদক্ষেপ করছি।” গড়বেতা-৩ ব্লকের শঙ্করকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতও প্রথম দু’টি আর্থিক বছরে ৬৩ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। সেখানেও পানীয় জল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, স্কুলে মিড ডে মিলের রান্নাঘর, কালভার্ট সহ একাধিক কাজ হয়েছে। কিন্তু তারপরেই টাকা খরচ না হওয়ায় পরের ২টি বছর বরাদ্দ মেলেনি। নির্মাণ সহায়ক সুজিত ধাড়ার কথায়, “এ বার আমরা সব টাকা শেষ করে দিয়েছি। আশা, করছি আগামী বছর এই প্রকল্পে ফের টাকা পাব।”
এই টাকায় উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা যায় জেনেও বহু পঞ্চায়েতই অবশ্য এখনও উদাসীন। ফলে প্রকল্পের আওতায় থাকা বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত একবারও অর্থ পায়নি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে জামবনির কাপগাড়ি, গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের খাড়বান্দি প্রভৃতি। কাপগাড়িতে খরচের হিসাব নিয়মিত আপডেট হয় না। খাড়বান্দিতে অডিটে বিরূপ মন্তব্য রয়েছে। এরকম নানা কারনেই এদের মতোই বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রকল্পের আওতায় থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েই চলেছে। এই প্রকল্পে টাকা পেতে হলে ৫টি বিষয় অবশ্যই মানতে হয়। ৩১ জানুয়রির মধ্যে পরিকল্পনা ও বাজেট তৈরি করতে হবে, নিজস্ব তহবিল, রাজ্য অর্থ কমিশন, কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন ও সশক্তিকরণ প্রকল্পের ৬০ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হবে, খরচের হিসাব গ্রাম পঞ্চায়েত ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, অডিটে বিরূপ মন্তব্য থাকা চলবে না, গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজের অগ্রগতির মূল্যায়নে ৭০ নম্বর পেতে হবে (যা আগে ৬০ পেলেই হত)। এবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি যাতে কাজের নিরিখে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে ও অর্থ পেতে পারে সে জন্য প্রশাসনও বিশেষ নজরদারি চালাবে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। |
|
|
|
|
|