‘আপাতত বিপ্লব না হোক,
কিছু রিলিফ তো দিতে পারি’
কার্ল মার্কস: নমস্কার। আপনাকে এই নতুন বছরে অভিনন্দন জানাচ্ছি। লাল সেলাম কমরেড। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম তো হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ থেকে প্রকাশ কারাট ওরা কেউ পারেনি। ভারতের রাজধানী শহরে আপনি পেরেছেন।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল: ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু এখন আমারই ভয় করছে। এত প্রত্যাশা! এত কাঁটার মুকুট। চেষ্টা করছি। কিন্তু নীতি-ন্যায্যতা এক দিকে, কৌশল আর এক দিকে।
মার্কস: কমরেড, আপনি কি বঙ্গসন্তান?
কেজরিওয়াল: না। না। আমি তো রাজস্থানের বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত, আবার ক্ষেত্রীজাত। ও সব জাতপাত ব্যাপারটা আপনি ঠিক বুঝবেন না। আপনি তো শ্রেণির বাইরে বেরোতেই পারেননি। ধনী বনাম দরিদ্র। কিন্তু ২০১৪ সালের ভারত অনেক জটিল। এখানে তো ধনী-দরিদ্র দু’পক্ষই আম-আদমি।
মার্কস: আসলে আপনি দিল্লির শীতে যে ভাবে মাফলারটা জড়িয়েছেন আর খক খক করে কাশছেন তাতে আমার মনে হয়েছিল আপনি নিশ্চয়ই বাঙালি।
কেজরিওয়াল: আমি খড়্গপুর আইআইটি-র ছাত্র। বাংলা বুঝতে পারি। অল্পস্বল্প বলতেও পারি। কিন্তু বাঙালি কমিউনিস্টরাও এখন উল্টে আমাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। মধ্যমগ্রামের ধর্ষণ নিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য সিপিএম আমাদের দ্বারস্থ।
মার্কস: সে তো আপনার সাফল্য। এই দিল্লি পুরসভার প্রথম বামপন্থী মেয়র ছিলেন অরুণা আসফ আলি। তাঁর নামে দিল্লিতে রাস্তা আছে। ষাটের দশকে তখন রাজধানী দিল্লিতে কমিউনিস্টদের রমরমা। তখন তো ওরা আমার নাম নিয়েই দারিদ্র-বেকারি-অসাম্য বিরোধী লড়াই চালাচ্ছিল। আর আজ সেই রাজনৈতিক পরিসরটা আপনিই দখল করে নিয়েছেন।
কেজরিওয়াল: আমি তো আম আদমির দুঃখ দূর করব বলেছি। এ দেশের মানুষ কংগ্রেস আর বিজেপি দু’পক্ষের উপরেই বেদম চটে আছেন। কংগ্রেস শাসক দল। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এখন তীব্র জনমত। বিজেপি সেই পরিসর দখল করতে মরিয়া। আবার যারা বিজেপি বিরোধী তারাও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমাকে সমর্থন করছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটাকে বদলাব কী করে? আমাদের আম আদমি পার্টিতে যোগ দিয়েছেন বেসরকারি বিমান সংস্থার পরিচালক গোপীনাথ। আবার দলে আছেন দিল্লির এক জন অটোচালকও। আপনি প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র ঘোষণা করে বুর্জোয়াদের বিনাশের ইস্তেহার রচনা করেন। কিন্তু আমি শ্রেণিশত্রু চিহ্নিত করব কী করে? উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং জন’ নাটকে ফিলিপের মন্তব্য মনে আছে স্যার?
‘আমি যখন ভিখারি, তখন আমি গাল পেড়ে বলব, ধনী হওয়ার চেয়ে পাপ আর কিছু নেই। আর আমি যখন বড়লোক তখন ধনী হওয়াটাই মহত্ত্ব এবং ভিক্ষার চেয়ে কুকর্ম আর কিছু নেই।’
আসলে বিশ্ব সম্পর্কে সাধারণ মূল্যায়ন আমাদের নিজস্ব বিশেষ স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমি আজ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার চলছে। আমাকে তো ধনী আর দরিদ্র দু’পক্ষকে নিয়েই চলতে হবে। আমার আম আদমি হল সেই ব্যক্তি, যে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষমতা নামক বৃত্তের বাসিন্দা নয়। যারা ক্ষমতার মধু থেকে বঞ্চিত। যারা ভিভিআইপি নয়, এলআইপি— লেস ইমপর্ট্যান্ট পার্সন। সাধারণ নাগরিক। আর কে লক্ষ্মণের কার্টুনের কমনম্যান।
মার্কস: আসলে আপনার সমস্যা হল আপনি ব্যথিত মানবচিত্তে প্রত্যাশার মলম দিয়েছেন। পেইন কিলার ট্যাবলেটের মতো। কিন্তু অস্থায়ী প্রশমন। কিছু ক্ষণ পর আবার ব্যথা বাড়বে। আমি বলেছিলাম, এই আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় শ্রেণি সংগ্রামের কথা। পিরামিডের চুড়োয় আছে এলিটতন্ত্র। রাজনৈতিক-সামাজিক-সামরিক-সাংস্কৃতিক— নানা ধরনের অভিজাত তন্ত্র। কিন্তু লেনিন আমার অনেক কথা মন দিয়ে শুনলেন না। তাড়াহুড়ো করে নয়া আর্থিক নীতি ‘নেপ’ (নিউ ইকনমিক পলিসি) করতে গিয়ে কী যে করলেন আর কী যে করলেন না! স্তালিন এসে তো আর এক চরম পথে হাঁটলেন। কোথায় ভাবলাম, রাষ্ট্র শুকিয়ে মরবে, তা নয়, সেই রাষ্ট্রই স্বৈরতন্ত্রী আমলাতন্ত্র তৈরি করে সমাজকে গিলে খেতে চাইল। চিন-ও পরীক্ষা করতে করতে, ব্যবস্থাকে ঠেকাতে গিয়ে আমাকে ভুলে গেল। সাধে কি দুঃখ করে আমি আমার জামাইকে বলেছিলাম, আমি আর যা-ই হই মার্কসবাদী নই। আর আপনি তো ঈশ্বরবিশ্বাসী। কথায় কথায় বলছেন, এই জয় ঈশ্বরের অলৌকিক কৃপা। আপনার গুরু অণ্ণা হজারে তো অহিংসবাদী গাঁধীবাদী। আপনার মতাদর্শটা তবে কী?
কেজরিওয়াল: পথ চলতে চলতেই গন্তব্য খুঁজে বের করব। শঙ্করের চাঁদের পাহাড় খোঁজার মতো। এটুকু বলতে পারি, আমি আপস করব না। এই সমাজের সমস্ত আধুনিক মুচিরাম গুড়দের আমি টাইট দিয়ে যাব।
মার্কস: সমস্যাটা কোথায় জানেন? সমস্যাটা এই ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থাটা গিলে খায় আমাদের সকলকে। বিষয়টা জটিল। আমি লন্ডনের সমাধিতে শুয়ে আছি, কিন্তু আমি আজও ভূত হইনি। আমার এক ভাবশিষ্য এরিক হবসবম ক’দিন আগে মারা গেলেন। তিনিও বলেছেন, মার্কস শুরু করেছিলেন। শেষ করেননি। শেষ করার কাজটা আপনারও। পারবেন কি না সেটাই আপনার পরীক্ষা। চ্যালেঞ্জ।
কেজরিওয়াল: লোকসভা নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। রাজ্যে রাজ্যে লড়ব। ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার ভিতরে ঢুকে ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাব। মানুষকে বোঝাব দুর্নীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন এক সমাজ তৈরি করতে হবে।
মার্কস: জারদের তাড়িয়ে লেনিনও সেটা চেয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জ্যোতি বসুও তাই বলেছিলেন। কলকাতায় আমার মূর্তি স্থাপনা হয়েছে, কিন্তু মার্কসবাদ কোথায়? বললাম, ডিক্টেটরশিপ অফ দ্য প্রলেতারিয়েত। ওরা সেটা করে দিল ডিক্টেটরশিপ ওভার দ্য প্রলেতারিয়েত।
কেজরিওয়াল: আসলে ভারত নামক দেশটাও তো জটিল। আপনি শুধু ধনী বনাম দরিদ্রর লড়াই বলে নিম্নবর্গের উত্থানের কথা বলেন। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতা পর্ব এটি। দেখছেন তো ভারতে কত জাতপাত, কত আঞ্চলিক সত্ত্বার লড়াই, ধর্মীয় চেতনার বিচ্ছিন্নতা, ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে লড়াই। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের পর এক দিকে মধ্যবিত্ত সম্প্রসারিত হয়ে ৩০ কোটি হল। উপভোক্তার বাড়বাড়ন্ত হল মলে। বৃদ্ধি হলে আর্থিক প্রগতি। অন্য দিকে শহুরে গরিব ক্রমবর্ধমান। বস্তিতে ডিশ অ্যান্টেনা। অশনি সংকেত বা গণদেবতার সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রাম কোথায়? এই ভারতে আপনার সাবেকি মতবাদও অচল। এখন চাই বহুমুখী চলার পথ। আপাতত বিপ্লব না পারি, কিছু রিলিফ তো দিতে পারি।
মার্কস: ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টও তো বেকারভাতা আর বিধবাভাতা দিয়ে মানুষের কল্যাণ চেয়েছিল। আর দুর্নীতি দুর্নীতি বলে এত চিৎকার করছেন, কিন্তু দুর্নীতি তো শুধু নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লকে আছে তা তো নয়। দুর্নীতি তো ভারতীয় ব্যবস্থার শিকড়ে। টাকা দিয়ে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করতে প্রস্তুত। অটোরিকশা চালক ভুয়ো মিটার দিয়ে চুরি করে। সেই কবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছিল জিহ্বাগ্রে যেমন মধু, রাজকর্মচারীদের তেমনই উৎকোচ। ধননন্দ-র চুরির রাজত্বের প্রতিবাদেই ছিল চাণক্যের বিদ্রোহ।
কেজরিওয়াল: সত্য। দুর্নীতিটাই ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে দুর্নীতি বিরোধী গণতন্ত্রের লড়াইটাও তো সত্য। সে সব আন্দোলন যত দিন স্থায়ী হতে পেরেছে, পেরেছে। এ আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে, এই সিস্টেম আমাকে গিলে খেতে পারে এই ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে বলছেন!
মার্কস: না, কমরেড। তা কখনওই বলছি না। শুধু বলছি, আমার তত্ত্বে একটা কথা ছিল ‘ভ্রান্ত চেতনা’। এই ভ্রান্ত চেতনায় প্রচণ্ড নেপালে বিপথগামী হয়ে আজ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। ভ্রান্ত চেতনায় বহু মাওবাদী জঙ্গল মাফিয়ায় পরিণত। আনুগত্য ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রের আন্দোলন বার বার আধিপত্যকামিতায় পর্যবসিত হয়। তোমাদের রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ‘ঘটে যা তা সব সত্য নহে’। অতএব সাধু, সাবধান!

—ফাইল চিত্র।

পুরনো সমাচার:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.