হাঁটু ছাড়িয়ে নেমেছে ঘিয়ে রঙের বারমুডা। মাঝ-পৌষেও গায়ে সবেধন ধপধপে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। আর মোজা ছাড়া একটু খসটে হয়ে যাওয়া স্নিকার। মধ্য রাতে বাড়ির সদর দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়েই হাঁক ছাড়লেন, “কই রে, গাড়িটা বের কর দেখি।”
সামনের আসনে...না উঠবেন না তিনি। ওটা তো তাঁর দলনেত্রীর জন্য পাকাপাকি সংরক্ষিত। ‘দিদি’র চওড়া হাসির চার বাই আড়াই দীঘল এক ফটো সেই আসনে। ভদ্রলোক পিছনের আসনে উঠেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বললেন, “চল দেখি, কত বড় মাতব্বর হয়েছে। রাত বিরেতে মচ্ছবের শেষ নেই!” শহরের নাম নবদ্বীপ। পড়ছি পড়ব করে শেষমেশ শীত একটু গা ঝাড়া দিতেই চারিদিকে রাতের বনভোজনের হিড়িক পড়ে গিয়েছে যেন। পৌষ রাতের ঘুম উধাও। তাঁর না হয় একটু গরম বাতিক, তা বলে পাড়া পড়শি লেপ-কম্বলে একটু আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করতেই ডাকসাইটে সাউন্ড বক্সে বেজে উঠছে ‘লুঙ্গি ডান্স’ কিংবা ‘...ঝিনকু নাকুর নাক্কুনাকুর...’। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। |
দিন কয়েক আগে সপ্তাহান্তের রাতে তারস্বরে সেই লুঙ্গি নাচের বাজখাঁই হুঙ্কার শুরু হতেই আর ঘরে থাকতে পারেননি তিনি। সন্ধে থেকেই পাড়া-প্রতিবেশীর নাগাড়ে ঘ্যানঘ্যানানি তো ছিলই, ‘‘দাদা একটা উপায় করুন। রাতের ঘুম তো গেছেই, পুলিশে নালিশ করলে উপদেশ শুনছি, কানে তুলো গুঁজে ঘুমোন। ছেলেপুলেরা না হয় একটু আমোদ করছে!’’ নাঃ আর পারা যায় না সত্যিই।
তিনি বেরিয়েই পড়লেন। সেই আদি অকৃত্রিম পোশাক। গাড়ি হাঁকিয়ে দোয়াপাড়ার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ল, টলোমলো পায়ে নাচন আর নৃত্যরতদের বৃত্তাকারে ঘিরে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিশি-বিদিশির হরেক কিসিমের বোতল। গাড়ির ভিতর থেকেই মনে মনে বললেন, “হুঁ, বড় বাড় বেড়েছে দেখছি!” কিন্তু দেখবেন কাকে, গাড়ি আর একটু এগোতেই ফাঁসিতলায় দ্বিগুণ আবেগে ছেলেপুলেরা নাচছে ‘বিড়ি জ্বালাইলে’র তালে। তাঁর সাধের নবদ্বীপে একি রাতের চেহারা! আর পারা যায় না। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে পাল্টা হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি, “কীরে, গাড়ি থেকে নামতে হবে নাকি?” তাঁর গাড়ির রং ছেলে ছোকরাদের চেনা। সাদা গোঁফের আড়ালে ওই হুঙ্কারও অচেনা নয়। কিন্তু এই মাঝ-পৌষের রাতে একি বেশ তাঁর, বারমুডা আর গেঞ্জি?
“দাদা আপনি...।” আমতা আমতা করে ছেলে-ছোকরার দল। “আমার শীত না গ্রীষ্ম দিয়ে তোদের কি? তা বলে রাত বিরেতে তোরা কি করছিস?” আবার খিঁচিয়ে ওঠেন তিনি। নিমেষে বন্ধ হয়ে যায় সাউন্ড বক্স। থমকে গিয়েছে লুঙ্গি-নাচ। দীঘল সাউন্ড বক্সের আড়ালেই পারলে সেঁধিয়ে যায় তারা।
কিন্তু তিনি ছাড়বার পাত্র নন। গাড়ি থেকে নেমে এসে সটান জানিয়ে দেন, “এটা নবদ্বীপ, এখানে এই সংস্কৃতি চলবে না। পিকনিক চলতে পারে। কিন্তু আওয়াজ হলে কিন্তু...আমার নামটা মনে আছে তো!”
তিনি বেরিয়েছেন শুনে খবর যায় থানাতেও। পুলিশও ছুটে আসেন। কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে তাদেরও জানিয়ে দেন তিনি, “ছিলেন কোথায় এতক্ষণ? আজকের পর নবদ্বীপে যেন এত রাত পর্যন্ত মাইক না বাজে। ব্যবস্থা নিন। না হলে আমি ব্যবস্থা নেব।” পুলিশ কর্মীরাও জানান ‘যে আজ্ঞে স্যার!’ মাথা চুলকে এক খাঁকি উর্দি পরামর্শ দিতে যান, “ঠান্ডা লেগে যাবে স্যার, গরম পোশাক পরে আসেননি তো।”
ফের গোঁপের আড়াল থেকে উড়ে আসে ধমক, “ঢের হয়েছে, আমার ঠান্ডা নিয়ে ভাবতে হবে না। রাতের নাচাগানা’টা বন্ধ করুন। না হলে....।”
রাত গভীর হয়। আর লুঙ্গি নাচন নয়। তাঁর ধমকে নবদ্বীপ ফিরে যায় পুরনো চেহারায়। নিশুতি রাতে নিশ্চিন্তে ঝরতে থাকে পৌষের শিশির।
বারমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি, রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের প্রতিমন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা গাড়িতে ওঠার আগে শুধু বলেন, “যত্তসব!” |