ঘুমপাড়ানি গুলিতে তাকে নিস্তেজ করে ফেলেছিলেন বনকর্মীরা। তোড়জোড় চলছিল, খাঁচা-বন্দি করে তাকে নিয়ে যাওয়ার। জনতার অবশ্য সায় ছিল না তাতে। বনকর্মীদের অনুরোধ-উপরোধ ঠেলে সরিয়ে অচৈতন্য প্রাণীটির উপরে বাঁশ-লাঠি, দা-বল্লম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিমেষে তাকে কুপিয়ে মেরে ফেললেন গ্রামবাসীরা।
রক্তাক্ত প্রাণীটার নিথর দেহের উপরে পা তুলে বীর দর্পে দাঁড়িয়ে মোবাইলে পর পর কয়েকটা ছবিও তুলে ফেললেন কয়েক জন। তারপর বীরের হাসি নিয়ে ফিরে যাওয়ার আগে ছুড়ে দিয়ে গেলেন মন্তব্য, “গ্রামে বাঘ ঢুকবে আর আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব!”
মঙ্গলবার সকালে ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের ধূপঝোরা গ্রামে এ ভাবেই গ্রামবাসীদের ‘অনুশাসনের’ শিকার হল একটি পূর্ণ বয়স্ক চিতাবাঘ। জনা সাতেক বনকর্মী অসহায় চোখে দেখলেন গরুমারার জঙ্গল থেকে মূর্তি নদী পার হয়ে গ্রামে ঢুকে পড়া পূর্ণ বয়স্ক চিতাবাঘটির করুণ পরিণতি।
জলপাইগুড়ির বন্যপ্রাণ (২) বিভাগের ডিএফও সুমিতা ঘটকের আক্ষেপ, “চিতাবাঘটি কোনও প্রাণঘাতী হামলাও করেনি। বনকর্মীরা চিতাবাঘটিকে অচৈতন্য করে গাড়িতে তোলার তোড়জোড় করছিলেন, তখনই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। মেটেলি থানায় অভিযোগ করেছি।” |
তবে, বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় উপর দিকে থাকা চিতাবাঘ পিটিয়ে মারার মতো ঘটনার পরেও স্থানীয় পুলিশের নির্বিকার ভূমিকায় বিস্মিত বন কর্তারা। ঘটনার প্রায় বারো ঘণ্টা পরেও এ ব্যাপারে গ্রেফতার তো দূর অস্ৎ পুলিশের দায়সারা মন্তব্য, “অভিযোগে কারও নাম না থাকলে আবার গ্রেফতার কিসের!” বন দফতরের এক শীর্ষ কর্তা দাবি করেছেন, বন্যপ্রাণ আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে বন ও তার প্রাণিকুল রক্ষার দায়িত্ব শুধু বন বিভাগের নয়। জঙ্গল সংলগ্ন থানারও এ ব্যাপারে সমান দায়িত্ব রয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, “গ্রামবাসীদের জনে জনে নাম জানা কি বনকর্মীদের পক্ষে সম্ভব? ঘটনার পরে বনকর্মীরা যে অভিযোগ দায়ের করেছেন পুলিশের উচিত তার ভিত্তিতেই গ্রামে গিয়ে তদন্ত করা।” এসডিপিও (মালবাজার) অরিন্দম সরকার অবশ্য বলেন, “মালবাজার এলাকায় বন্যপ্রাণী পিটিয়ে মারা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ এ যাবৎ পাইনি। বন দফতরের অভিযোগ হাতে পেলে পুলিশ তা খতিয়ে দেখবে।” কিন্তু পুলিশ কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে না?
উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গল ঘেঁষা গ্রাম কিংবা চা বাগানের শ্রমিক বস্তিতে চিতাবাঘ, বাইসন, এমনকী হাতি, গন্ডারের আনাগোনা নতুন নয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি গ্রামে তাদের পিটিয়ে মারার মতো ঘটনারও সাক্ষীও রয়েছে উত্তরবঙ্গ। বন দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, বাইসন ও চিতাবাঘ পিটিয়ে মারার দায়ে গত বছরেই জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় অন্তত ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া কিংবা সুন্দরবনেও বন্য পশুর প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতারের নজির রয়েছে। গত বছর উত্তরাখণ্ডের করবেট জাতীয় উদ্যান ও অসমের কাজিরাঙা ও মানস জাতীয় উদ্যানে চিতাবাঘ, গন্ডার ও হাতি শিকারের দায়ে গ্রেফতারের সংখ্যা ৩৭। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠনগুলির দাবি, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন?
এ দিন, সকালে ঘন কুয়াশার মধ্যেই ধূপঝোরার জয়ন্তী গ্রামের বাসিন্দা অতীন রায়ের বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে নজরে পড়ে চিতাবাঘটিকে। নিমেষে ভিড় জমে যায়। শুরু হয় হল্লা আর ক্রমাগত তাকে লক্ষ করে ইট ছোড়া। এই সময়ে তার সামনে পড়ে যান স্থানীয় এক ভ্যান চালক। তাকে আঁচড়ে দিয়ে এ বার সে এক লাফে গিয়ে ঢোকে আফজল হোসেনের গোয়ালঘরে। উৎসাহী এক গ্রামবাসী ও অত্যুসাহী এক পর্যটক সেখানে ঢুকে আহত চিতাবাঘটির ছবি তুলতে যান। ক্ষিপ্ত পশুটি তাঁদেরও সামান্য আঁচড়ে দেয়। তবে কারও আঘাতই গুরুতর নয়। ইতিমধ্যেই বনকর্মীরা এসে পড়েন ঘটনাস্থলে। তাঁরা ঘুমপাড়ানি গুলিতে চিতাবাঘটিকে কাবু করে ফেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু জঙ্গল ছেড়ে গ্রামে ঢোকার শাস্তি দিতে গ্রামবাসীরা এর পর কুপিয়ে-খুঁচিয়ে নিমেষে মেরে ফেলেন তাকে। |