|
|
|
|
বারবার হুঁকাবার |
পুরনো নেশাকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে জেন ওয়াই। হুঁকো খাওয়া। লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায়। |
হিমে ভেজা এই মস্তির মরসুমে উষ্ণ হতে এ শহরে এখন ছলা-কলার হাজারো পসরা! ডিজে নাইট, ধুন্ধুমার লাইভ মিউজিক, ডিস্কো থেক-য়ের তুঙ্গ ডান্সফ্লোর। এ সবের মতোই শীতের শহরে ‘ইন’ হুজুগ, সুগন্ধি তামাকের গোলাপি ধুম। উত্তুরে হাওয়ার পিঠে সওয়ার হয়ে, সেই সুখটানে শরীর ভর্তি সেঁক-তাপ নিতে জমজমাট হুঁকা জয়েন্টগুলো।
হুঁকা ঠেকের হদিস
উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহর জুড়ে এখন হুঁকার অজস্র জয়েন্ট। শুধু ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, সল্টলেক, সদর স্ট্রিট, শরৎ বোস রোড, গড়িয়াহাট, এজেসি বোস রোডর অভিজাত পানশালা নয়, যদুবাবুর বাজারের লাউঞ্জও হয়ে উঠেছে বিন্দাস হুঁকা প্লেস।
নাইট ক্লাবের সঙ্গে টক্কর দিতে শহরের বহু কফিশপ-রেস্তোরাঁও এখন এক্সটেনশন হিসাবে রাখছে হুঁকা পার্লার। তা সে এলগিন রোডের ক্যাফে হোক বা আলিপুর- সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের রুফটপ। কিন্তু কলকাতার এই সব হুকার ঠেকে শুধু কি জেন-ওয়াই ভিড় জমায়? কথা হচ্ছিল এক হুঁকা জয়েন্টের কর্ণধার পাপিয়া ঘোষালের সঙ্গে। বললেন, “ভাবার কোনও কারণ দেখি না। এই আড্ডা সাঁলোতে সব বয়েসের লোকই তো আসেন হুকা খেতে।”
ফরিস্তা ফ্লেভারে সুখটান
বিদেশি সিনেমার পর্দায়ও হুঁকার ব্যবহার দেখানো হয়েছে। জনপ্রিয় হুঁকা সেবনকারী কাল্পনিক চরিত্র জাবাকে দেখা যায় সায়েন্স ফিকশন ছবি ‘রিটার্ন অব দি জেডি’-তে। জাবার হুঁকায় অদ্ভুত ভাবে কোনও কয়লার টিক্কা দেখা যায় না। অথচ সব সময় ধোঁয়ায় ভরপুর! শুধু তাই নয়, স্মোক চেম্বারের নীচে খাবার পাত্রে সে কীট সংগ্রহ করে মুখরোচক হিসেবে! জাবার হুঁকা শহরে না দেখা গেলেও, কলকাতার ‘হুঁকা মুখো হ্যাংলা’রা এই মরসুমে পছন্দ করছেন ডাবল অ্যাপেল, অরেঞ্জ, মিন্ট, রসনা, কিরি, রোজ, গোয়াভার মতো সুগন্ধি তামাক। সেন্ট জেভিয়ার্সের অরিজিৎ সিংহ যেমন বলছিলেন, “মিন্টের সঙ্গে যে কোনও ফ্রুট ফ্লেভার ট্রাই করার চল বেশি। বেশির ভাগ সময় নিজেও সেটাই করি।” কলেজ ক্রাউডের কাছে মিক্সড ফ্লেভারের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা রয়েছে ‘কড়ক’ তামাকেরও। ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটির ছাত্রী অনুরাধা সরকার বললেন, “হুঁকাটা বেশ অন্য রকম! রসনা, চকোলেট, মিন্ট এগুলো খুব প্রিয় ফ্লেভার আমার। তবে অনেকে খুব কড়া কিছু পছন্দ করে।” |
|
কী বলছে জেন ওয়াই
ফি শুক্র-শনিবার শহরের বেশ কয়েকটি হুঁকা জয়েন্টে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে সেক্টর ফাইভের কর্মী পৃথ্বীরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। হুঁকা জয়েন্টে কেন? “যদ্দুর জানি, এটাতে কোনও নেশা হয় না। নানা রকম ফ্লেভারে ধোঁয়া টানা যায়। একসঙ্গে এত ধোঁয়া দেখতে দিব্যি লাগে আমার।” আইটি প্রফেশনাল শুভ্রজিৎ ভৌমিকও নিয়মিত যান হুঁকা জয়েন্টে। “হুঁকা ব্যাপারটা বেশ ট্রেন্ডি। কোনও নেশা নেই। ইন ক্রাউডে থাকার জন্য হয় শুক্র অথবা স্যাটারডে নাইটে চলে যাই। জিভে বহুক্ষণ ফ্লেভার থেকে যায়। খরচও কম,” বলেন তিনি।
বড়রা যা বলছেন
জেন ওয়াইয়ের হুকা-হুজুগ নিয়ে এতটুকু বিরক্ত নন নাকতলার মৌসুমী দাশগুপ্ত। বললেন, “মেয়েকে তো দেখছি, সব ব্যাপারেই ভীষণ রকম এক্সপেরিমেন্টাল ওরা। এখন পাল্টে যাওয়া সময়ে হুঁকা নতুন একটা হুজুগ ওদের।” গিরিশ পার্কের তিন প্রজন্মের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী শঙ্খনাথ সাহা অবশ্য সাফ জানালেন, “এ পাড়ায় কিছু দিন আগেই একটা মিষ্টির দোকান উঠে গিয়ে হুঁকাবার হয়েছে। কিন্তু ফ্যামিলির কেউ সেখানে গিয়ে হুঁকা টানবে এটা মেনে নিতে পারব না। সুগন্ধি হলেও তামাকের নেশা তো ক্ষতিকর।”
বাড়ি বাড়ি হুঁকাবার
ইদানীং হুঁকা বিক্রির চল বেড়েছে কলকাতায়। কেউ কেউ নিছক শো-পিস হিসাবেই ফ্ল্যাটে রাখতে চান হুঁকা। শখের ফোটোগ্রাফার আত্রেয়ী বিশ্বাস যেমন। বললেন, “শো-পিস হিসেবে ডিজাইনার হুঁকা অনবদ্য।” স্রেফ সে কালের জিনিস বলেই ঘরে শো-পিস হিসেবে একটি ডিজাইনার হুঁকা সাজিয়ে রাখার কথা বললেন উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের পাঁচ পুরুষের বনেদি বাসিন্দা কাঞ্চন দা।ঁ বললেন “না খেলেও শৌখিন জিনিসটি ঘর সাজানোতে মন্দ নয়। তবে ফরাস তো নেই, হালফিলের সোফার পাশেই রেখেছি!”
বনফায়ার, বারবিকিউয়ের শীত পার্টিতে শৌখিন মৌতাতের জন্য হুঁকার কদর এখন তুমুল। শপিং মলে হাজারের মধ্যে রয়েছে দিল্লি-মেড নানা সাইজের কাচ-পিতল-কাঠের হুঁকা। এমনকী লার্জ-এক্সট্রা লার্জ সিরিয়ার হুঁকাও মিলবে এই শহরে। প্রায় ত্রিশ রকমের চারকোল ট্যাবলেটও রয়েছে। ঠান্ডা পড়তেই ডিজাইনার হুঁকার সঙ্গে বাড়ছে ‘মেহাস’, ‘আলফকির’, আলফরিন’, ‘আফরোজ’-এর মতো সুগন্ধি দুবাই-তামাকের জোগান! ইতিহাস বলছে, মোঘল সম্রাট আকবর নাকি, এই উপমহাদেশে হুক্কার প্রথম প্রচলন করেন। আকবরের নির্দেশে পারস্যের হেকিম আবুল ফতেহ গিলানি হুক্কার নকশা উদ্ভাবন করেন। চিকিৎসকদের সতর্কবার্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই হুঁকায় সুখটানে মাতছে শহর। নইলে, হুঁকা নিয়ে এত উন্মাদনা দেখা যায় এ কলকাতায়?
|
এক ছিলিম |
হুঁকা পার্লারে যাওয়া মানেই ফেসবুকে
বেশ ঝিঙ্কু স্টেটাস দেওয়াও।
সৌরভ পাল
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
দু’একদিনের জন্য ঠিক আছে।
কিন্তু রোজ খাওয়াটা বেশ খরচের।
শৌভিক চক্রবর্তী
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় |
নাইটক্লাবের হুজ্জুতি নেই। আলো-আঁধারি
পরিবেশে গান শুনতে শুনতে আড্ডা দেওয়া যায়।
সৃজনী দে
এসআরএফটিআই |
শহরের হাওয়ায় এটাই এখন হুজুগ।
ব্যক্তিগত ভাবে খুব যে ভাল লেগেছে বলব না।
সায়ন্তনী অধিকারী
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় |
|
ডাক্তাররা বলেন নো-নো |
সিগারেট বা বিড়ির তুলনায় ক্ষতি কম
এ কথা ঠিক। কিন্তু হুঁকার সুগন্ধি
তামাকের পোড়া ধোঁয়ায় যে
অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন রয়েছে,
তা স্বাস্থ্যের পক্ষে চরমতম ক্ষতিকর।
সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়
আরজিকরের রেডিওথেরাপির প্রধান অধ্যাপক |
আগে মনে করা হত জলের ভেতর
দিয়ে হুঁকার ধোঁয়া টানা হয় বলে নিরাপদ।
কিন্তু মোটেই নিরাপদ নয়। একবার টানাও
যথেষ্ট ক্ষতিকর। এ থেকে ব্রঙ্কাইটিস ও
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগ,
হৃদরোগ, এমনকী লাং ক্যানসার
পর্যন্ত
হতে পারে
ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়
পালমোনোলজিস্ট |
|
|
|
|
|
|
|