কল্যাণীতেও না। রায়গঞ্জেও না।
এইমস হচ্ছেই না এ রাজ্যে।
সোমবার কলকাতায় এসে এমন ইঙ্গিতই দিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ। জমি নিয়ে সমস্যার জেরেই কি বাতিল হল এইমস? আজাদ জানান, শুধু এ রাজ্যে নয়। জমি সমস্যার জেরে গোটা দেশেই আপাতত নতুন এইমস-এর পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। তার বদলে দেশের ৩৯টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে সুপার স্পেশালিটি স্তরে উন্নীত করা হবে। তার মধ্যে তিনটি মেডিক্যাল কলেজ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া সম্মিলনী, মালদহ এবং দার্জিলিং মেডিক্যাল কলেজ।
আজাদের কথায়, “এইমস তৈরি করতে প্রচুর জমি প্রয়োজন। জমি অধিগ্রহণ করাটা একটা বড় সমস্যা গোটা দেশেই।” সেই কারণেই এইমস-এর পরিকল্পনা স্থগিত করা হচ্ছে। “শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশেই এই নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে।” এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে এইমস-এর মতো ছ’টি প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজ শেষ। সপ্তমটির কাজ চলছে। অষ্টমটি হওয়ার কথা ছিল রায়গঞ্জে। মন্ত্রীর কথায়, “কিন্তু সেখানে প্রকল্পটা ‘টেক অফ’ করল না।” জমি পাওয়া গেলে ফের ভাবনাচিন্তা হবে।
কিন্তু যেখানে জমি ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই কল্যাণীতে কেন এইমস হচ্ছে না? রায়গঞ্জ আর কল্যাণীর মধ্যে দড়ি টানাটানিই কি এর কারণ? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অবশ্য এ কথা মানতে চাননি । তাঁর যুক্তি, “এইমস তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। সেই কারণেই আমরা এইমস নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নতুন ফর্মুলার কথা ভাবছি। দেশ জুড়ে কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজকে সুপার স্পেশ্যালিটি স্তরে উন্নীত করাই সেই নতুন ফর্মুলা।”
রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশই অবশ্য দাবি করছেন, এইমস আর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের মধ্যে নামের কৌলীন্য ছাড়া আর বিশেষ পার্থক্য নেই। এইমস-এ অন্তত ২৫০টি সুপার স্পেশালিটি শয্যা থাকার কথা। আজাদ জানিয়েছেন, বর্তমান মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামোর মধ্যেই তাঁরা ২৫০টি সুপার স্পেশালিটি শয্যার ব্যবস্থা করছেন। এইমস-এর মতোই এই প্রতিষ্ঠানগুলিতেও যে কোনও জটিল রোগের চিকিৎসা পাওয়া যাবে। একই ছাতার তলায় থাকবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা।
রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির উদ্যোগে ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৮২৩ কোটি টাকা বরাদ্দে রায়গঞ্জে ১০০ একর জমিতে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির কথা ঘোষণা করেছিল। হাসপাতাল তৈরির জন্য রাজ্য সরকারকে জমি ও পরিকাঠামো গড়ে দিতে হবে বলে জানানো হয়েছিল। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দল রায়গঞ্জের শীতগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের পানিশালা এলাকায় হাসপাতাল তৈরির জন্য জেলা প্রশাসনের চিহ্নিত করা ১১০ একর জমি পরিদর্শন করে কেন্দ্রকে সবুজ সঙ্কেত দেয়।
কিন্তু রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও রাজনৈতিক স্বার্থে রায়গঞ্জে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করা হয়নি বলে কংগ্রেসের অভিযোগ। এখন তারই খেসারত দিয়ে এইমস হাতছাড়া হল বলে তাদের দাবি। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে উন্নত পরিষেবা হয়তো মিলবে, কিন্তু নতুন এইমস হলে ডাক্তারি পঠনপাঠনের সুবিধা বাড়ত। রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির দাবি, “মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতাল তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ না করাতেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণে সমস্যার কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের দাবিতে খুব শীঘ্রই কংগ্রেস বড়সড় আন্দোলনে নামবে।”
অন্য দিকে তৃণমূলের বক্তব্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হবে না, এটা বরাবরই সরকারের নীতি। জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের পরিষদীয় সচিব অমল আচার্য এ দিন বলেন, রাজ্য সরকার কৃষিজমি নষ্ট করে হাসপাতাল তৈরির বিরোধী বলেই জমি অধিগ্রহণ হয়নি। পরিবর্তে কল্যাণীতে এইমসের জন্য ১১৮ একর জমি চিহ্নিত করেছিল রাজ্য। গুলাম নবি আজাদ এ দিন সে ব্যাপারেও আশার কথা শোনাননি। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কি তাঁর কোনও আলোচনা হয়েছে? আজাদ জানান, হয়নি। রাতে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “গুলাম নবি এ দিন যা বলেছেন, সেটা তাঁর নিজের কথা। এ ব্যাপারে আমরা কোনও মন্তব্য করব না।”
এ দিন চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটে (সিএনসিআই) পরিচালন সমিতির সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন আজাদ। পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই সমিতির চেয়ারম্যান এবং রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহকারী চেয়ারপার্সন। সেই অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হাজির ছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, “আমরা একে অপরকে অনেক দিন ধরে চিনি। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি।” বৈঠকের পরে মমতা চলে গেলেও হাসপাতালে কিছুক্ষণ থেকে গিয়েছিলেন আজাদ। প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথাবার্তার পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন তিনি। তখনই জানান, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজকে সুপার স্পেশালিটি স্তরে উন্নীত করার জন্য ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু এ বার বাঁকুড়া, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং মেডিক্যাল কলেজের জন্য বরাদ্দ হবে ১৫০ কোটি টাকা করে। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ৭৫ শতাংশ টাকা দেবে কেন্দ্র। বাকি ২৫ শতাংশ খরচ করবে রাজ্য।
উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, গত বছরের ২৭ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জেলা সফরে এসে রায়গঞ্জ ও ইসলামপুরে দুটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির কথা ঘোষণা করে গিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজ্য সরকারের সেই নীতিকেই সমর্থন করলেন। কংগ্রেসের পাল্টা দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল উন্নীত হতে চলেছে। এর সঙ্গে এইমসের ধাঁচে হাসপাতালের কোনও সম্পর্ক নেই। দীপার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের ঘাড়ে পা দিয়ে সাফল্য দাবি করতে চাইছেন।” |