জেলের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখায় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে জলবসন্ত ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সামনে উঠে এল। সংক্রমণ আটকানোর কাজে গাফিলতি রয়েছে বলে স্বীকার করছেন জেল কর্তৃপক্ষের একাংশই। যদিও কারা দফতরের আই জি রণবীর কুমারের কাছে এ বিষয়ে কোনও তথ্য পৌঁছয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে সংক্রমণ ঠেকানোর বিষয়ে জেল-কর্তৃপক্ষের যে গাফিলতি আছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন খোদ রাজ্যের কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি। তিনি ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রতি বছর দমদম-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বন্দি আবাসিকেরা জলবসন্ত (চিকেন পক্স)-এ কমবেশি আক্রান্ত হন। কিন্তু কখনওই আক্রান্তের সংখ্যাটা ৫০ ছাড়ায়নি। ২০১২ সালে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে জলবসন্তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৮। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮১-তে। আর, ২০১৪-র প্রথম সপ্তাহও কাটেনি। এর মধ্যেই নতুন করে আরও ১১ জন বন্দি জলবসন্তে আক্রান্ত হয়েছেন। জেলকর্তাদের কথায়, “এই মুহূর্তে যে হারে জলবসন্তের প্রকোপ বাড়ছে, তাতে সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে বন্দিদের মধ্যে তা আরও ছড়িয়ে পড়বে।”
এ বছর দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে এই অবস্থা হল কেন? কারা দফতরের কর্তাদের ব্যাখ্যা, অন্য জেলগুলিতে যেখানে জলবসন্ত প্রতিরোধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেখানে দমদমে সেই প্রক্রিয়াতেই খামতি ছিল। তা ছাড়া, রাজ্যের অন্য জেলের তুলনায় দমদম জেলে বন্দির সংখ্যাও বেশি। ৪২টি ওয়ার্ড মিলিয়ে দমদমে থাকতে পারেন বড়জোর ২৬০০ বন্দি। সেখানে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা চার হাজারের কাছাকাছি। ফলে, জলবসন্তের সংক্রমণের সম্ভাবনাও অনেক বেশি।
জেলের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে জলবসন্ত রোখার সবচেয়ে বড় উপায় হল, রোগের সংক্রমণকে যেনতেন প্রকারে আটকে দেওয়া। এ ছাড়া, দরকার জলবসন্তে আক্রান্ত এলাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখা। এই দুই কাজেই গাফিলতি পাওয়া গিয়েছে দমদম জেলে। জেলের এক কর্তার কথায়, “সাধারণত বন্দিদের মশারি দেওয়া হয় না। কিন্তু অন্য জেলগুলিতে চিকেন পক্সে আক্রান্ত বন্দিদের যতদিন পর্যন্ত সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে, তত দিন মশারি দেওয়া হয়। একটি ওয়ার্ডকে বসন্তরোগীদের জন্য পৃথক করে সেখানে তাদের রাখা হয়। আক্রান্তেরা যে সব চাদর ব্যবহার করেন, সেগুলিও সঠিক ভাবে জীবাণুমুক্ত করার পরেই ব্যবহার করা হয়। সংক্রমণ আটকাতে পৃথক ওয়ার্ডটি বিশেষ ভাবে পরিচ্ছন্ন রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়।”
কারা-কর্তাদের দাবি, এই সবক’টি কাজেই চলতি বছর খামতি ছিল দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। কারা দফতরের এক কর্তার কথায়, “জেলের ভিতরে ‘আইসোলেশন ডিজিজ ওয়াল’ নেই। আক্রান্তদের যে সব সেলে রাখা হচ্ছে, সেগুলিও ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে না।” তাঁর দাবি, “দমদম জেলের ভিতরে যে কম্বল ব্যবহার করা হচ্ছে, তা-ও ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে না বলে চিকিৎসকেরা মনে করছেন। বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল শুধু দু’এক দিন রোদে দিয়ে জেলের অন্য বন্দি আবাসিকদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। ফলে, ওই কম্বল থেকেই সংক্রমণ সহজে ছড়িয়ে পড়ছে জেলের অন্য বন্দিদের মধ্যে।”
দমদম জেলে কর্মরত এক চিকিৎসক এর পিছনে বাংলাদেশি বন্দিদেরও দায়ী করছেন। তিনি বলেন, “দমদম জেলে বাংলাদেশি বন্দির সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। এই বন্দিরা অনেকেই জলবসন্তের জীবাণু শরীরে নিয়ে জেলে আসছেন। তাঁদের মাধ্যমে জেলে ফের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।” তাঁর মতে, “জেলের হাসপাতাল জলবসন্তের ওষুধ অধিকাংশ সময় থাকে না। সেখানে সংক্রামক রোগের চিকিৎসার পরিকাঠামো অপ্রতুল।”
দমদম জেল ছাড়াও কলকাতায় আরও দু’টি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার রয়েছে। আলিপুর এবং প্রেসিডেন্সি। কিন্তু ওই দু’টি জেলে জলবসন্তের সংক্রমণ এই মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েনি। এর কারণ হিসেবে আলিপুরের এক কর্তা বলেন, “আমাদের এখানে জলবসন্ত হলে আলাদা তো রাখা হয়ই। চেষ্টা করা হয় প্রথম কয়েক দিন অন্তত মশারির ভিতরে রাখার। সে ক্ষেত্রে তাঁদের উপর একটু বেশি নজরদারি রাখতে হয় এই যা। এটাই দমদমে হয় না।” একই ব্যবস্থা নেওয়া হয় প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারেও। কারামন্ত্রী বিষয়টি জানলেও কারা দফতরের আইজি রণবীর কুমার বলেন, “এ বিষয়ে কোনও তথ্য এখনও আমার কাছে এসে পৌঁছয়নি।” কারামন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি অবশ্য বলেন, “আমার কাছে খবর এসেছে যে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে চিকেন পক্স হচ্ছে। তবে সরকারি ভাবে পরিসংখ্যানটা আমাকে এখনও জানানো হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্য দফতরের যে অফিসারেরা সেখানে রয়েছে, আমি তাঁদের ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কম্বল ইত্যদি যাতে ঠিক ভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়, তা-ও দেখতে বলেছি।” |