লগ্নির শ্রেষ্ঠ জায়গা কী? এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর হয় না। মানুষের বয়স, তহবিলের পরিমাণ, লগ্নির উদ্দেশ্য, ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য এবং করের দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শ লগ্নির জায়গা বিভিন্ন রকম হতে পারে। আজ আমরা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব, বিশেষ বিশেষ শ্রেণির লগ্নিকারীর জন্য কোন কোন লগ্নি প্রকল্প বেশি উপযোগী হতে পারে।
ছাত্রছাত্রী: হাতখরচ, মোবাইল-খরচ বাঁচিয়ে এরা নিয়মিত টাকা জমাতে পারে ব্যাঙ্কের রেকারিং ডিপোজিটে। এতে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে ছোট বয়স থেকেই। প্রত্যেক পড়ুয়ার নিদেনপক্ষে একটি করে সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা উচিত, যার ব্যবহার তারা শিখতে পারে ছাত্রাবস্থা থেকেই।
সদ্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা মানুষ: এঁদের টাকা জমাতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। প্রথম দিকে সাংসারিক দায়দায়িত্ব তেমন থাকে না। কম থাকে করের চাপ। এই অবস্থায় নিয়মিত টাকা জমানো যেতে পারে রেকারিং ডিপোজিটে, এসআইপি পদ্ধতিতে মিউচুয়াল ফান্ডে এবং পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডে (পিপিএফ)। স্বনিযুক্ত মানুষ যাঁদের সংস্থাগত প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুযোগ নেই, তাঁরা দীর্ঘমেয়াদে পিপিএফ অ্যাকাউন্টে টাকা জমালে ভাল করবেন। অল্প অল্প করে ভাল শেয়ার কেনার কথাও ভাবতে পারেন এই শ্রেণির মানুষ। কম বয়সেই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে ইক্যুইটিতে লগ্নির অভ্যাস করলে তা দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফল দিতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ লগ্নির জগতে প্রবেশ করার এটিই আদর্শ সময়। অন্য দিকে জীবনবিমার কথাও ভাবতে হবে এই সময় থেকে।
৩৫ থেকে ৫০ বছর বয়স্ক মানুষ: এই বয়সে সাংসারিক দায়িত্ব বাড়ে। থাকে ঋণের চাপ। পাশাপাশি বেড়ে ওঠে করের বোঝাও। ফলে শক্ত হয়ে ওঠে বড় আকারে সঞ্চয় করা। কম হলেও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নিয়মিত সঞ্চয় করে যেতে হবেই। এই সময়ে লগ্নি করতে হবে পিপিএফ এবং অন্যান্য কর সাশ্রয়কারী প্রকল্পে। প্রয়োজনে এসআইপি পদ্ধতিতে নিয়মিত লগ্নি করা যেতে পারে সোনায়। অতিরিক্ত অর্থ হাতে থাকলে চালিয়ে যাওয়া যায় ইক্যুইটি এবং মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি। আপৎকালীন অবস্থার জন্য কিছু টাকা অবশ্যই ফেলে রাখতে হবে ব্যাঙ্ক অথবা শর্ট টার্ম/আলট্রা শর্ট টার্ম অথবা লিক্যুইড ফান্ডে।
৫০ থেকে ৬০ বছর বয়স্ক মানুষ: যাঁদের কর্মস্থলে পেনশনের ব্যবস্থা নেই, তাঁদের এই বয়স থেকেই পেনশনের কথা ভাবতে হবে। যোগদান করতে হবে সরকারি নিউ পেনশন স্কিম (এনপিএস)-এর মতো কোনও প্রকল্পে। যাঁরা সর্বোচ্চ করের আওতায় পড়েন, তাঁরা প্রতি বছর সাধ্য মতো করমুক্ত বন্ড কিনে রাখার কথা ভাবতে পারেন। এতে অবসরের পরে করের চাপ কম থাকবে। পিপিএফ অ্যাকাউন্টের মেয়াদ ফুরিয়ে থাকলে তা ৫ বছর করে বাড়িয়ে নিন। যাঁরা কম করের আওতায় পড়েন, তাঁরা সদ্য চালু হওয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইনফ্লেশন ইনডেক্স বন্ড কিনে রাখার কথা ভাবতে পারেন। ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য থাকলে এই বয়সেও ইক্যুইটি কেনাবেচা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
প্রবীণ নাগরিক: বয়স ষাট পেরোলে আইনের চোখে আমরা প্রবীণ। অতিরিক্ত কিছু সুযোগ-সুবিধাও জোটে এই সময়ে। কিছুটা হাল্কা হয়ে আসে সাংসারিক দায়দায়িত্ব। এই বয়সে অবসর নেন বেশির ভাগ চাকরিজীবী মানুষ। যাঁদের পেনশনের ব্যবস্থা আছে, তাঁদের অবসর জীবন বেশ ভালই বলতে হবে। পেনশনের হার এখন ভালই। প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটি বাবদ প্রাপ্ত টাকাও এখন আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এই টাকা ঠিক জায়গায় পরিকল্পনা মতো লগ্নি করলে অবসর জীবনে অভাব হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া বিচক্ষণ মানুষেরা অবসরের আগেই পরিকল্পনা মতো জমিয়ে ফেলেন মোটা তহবিলযাতে চড়া মূল্যবৃদ্ধির বাজারেও অসুবিধা না-হয় এবং অবসরের পরেও যেন জীবনযাত্রার মান নামাতে না-হয়। অবসরের পর এই সব তহবিল কিন্তু লগ্নি করতে হবে সঠিক জায়গায়। নিয়মিত আয়ের জন্য তহবিলের একাংশ লগ্নি করা যেতে পারে কোনও ব্যাঙ্কের মাসিক/ত্রৈমাসিক আয় প্রকল্পে। লগ্নি করা যেতে পারে ডাকঘরের প্রবীণ নাগরিক প্রকল্পেও। সুদের হার কম হওয়ার কারণে ডাকঘরের মাসিক আয় প্রকল্প এড়িয়ে চলাই ভাল। প্রাপ্ত তহবিলের একাংশ লগ্নি করা যেতে পারে করমুক্ত বন্ডে। বর্তমানে চালু বন্ডে সুদের হার বেশ আকর্ষণীয়। সুদ পাওয়া যায় বছরে একবার। চিকিৎসা এবং অন্যান্য জরুরি খরচ মেটাতে কিছু টাকা অবশ্যই রাখতে হবে সেভিংস অ্যাকাউন্টে। পড়ে থাকা এই টাকার উপর সুদ বাবদ বেশি আয়ের জন্য ব্যাঙ্কের ‘লিক্যুই ফিক্সড’, ‘অটো সুইপ’ অথবা ‘এফডি লিঙ্কড’ ব্যবস্থার সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। অবসরের পর ধীরে ধীরে ইক্যুইটিতে লগ্নি কমিয়ে আনলেই ভাল হয়। অ্যাকাউন্ট রাখতে হবে বাড়ির খুব কাছে কোনও ব্যাঙ্কে। অনাবশ্যক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন প্রকল্পে ছোট ছোট আকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লগ্নি এই বেলা গুটিয়ে ফেললেই ভাল হয়। দেখতে হবে, অবসরজীবন যেন ফুরফুরে থাকে। আর্থিক দিক থেকে যেন কোনও অনাবশ্যক মানসিক চাপ না-আসে। |