আমি ৯৭, মিসেস সেন তো সবে ৮২
৭ নট আউট বললেও চলে।
কিন্তু রামানন্দ সেনগুপ্তের সামনে সে কথা বললে, উনি একটু সংশোধন করে বলেন, “আমার বয়স ৯৭ বছর ৭ মাস।”
প্রবাদপ্রতিম ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়াঁ যখন তাঁর পৃথিবীবিখ্যাত ‘দ্য রিভার’ ছবির শ্যুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁর দেখা হয়েছিল রামানন্দবাবুর সঙ্গে। সেই সিনেমায় ক্যামেরা অপারেটরের ভূমিকায় ছিলেন রামানন্দবাবু।
“ঋত্বিক ঘটকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’য়ের সিনেমাটোগ্রাফি আমার করা,” বলে একগাল হেসে ফেলেন তিনি।
আর সেই কথার রেশ ধরেই চলে আসে তাঁর অনান্য ছবির গপ্পো। যার মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে সুচিত্রা সেনের দু’টি ছবির চিত্রগ্রাহক হওয়ার অভিজ্ঞতা।
সংবাদ মাধ্যমে সুচিত্রাদেবীর অসুস্থতার কথা শুনেছেন তিনি।
পুরনো বন্ধুরা সব এক এক করে চলে গিয়েছেন। এই খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা খারাপ।
“সুস্থ হয়ে উঠুন মিসেস সেন। যত বার পুরনো কথা ভাবছি, এটাই মনে হচ্ছে। আমার তো ৯৭ বছর ৭ মাস বয়স। মিসেস সেন তো শুনেছি মাত্র ৮২,” খুব আস্তে কথাগুলো বলেন এ দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফার।
উলের বল থেকে সুতোতে টান মারলে যেমন তা আপনা আপনি খুলে আসে, ঠিক সে ভাবেই সুচিত্রা-প্রসঙ্গ তাঁকে পুরনো সব গল্পের ঝাঁপি খুলতে উস্কে দিল। কাঁপা গলায় বললেন, “যখন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি, তখনও মিসেস সেন জানতেন না যে, আমি সম্পর্কে ওঁর শ্বশুরমশাই হই!”
সম্পর্কে শ্বশুরমশাই? কিন্তু সম্বোধন করছেন ‘মিসেস সেন’ বলে? কানে অদ্ভুত লাগছে শুনে বললেন, “আমার মায়ের খুড়তুতো বোনের মেয়ে বুড়িদি হল আদিনাথবাবুর স্ত্রী। তুতু (মানে সুচিত্রাদেবীর স্বামী দিবানাথ সেন) হল বুড়িদি-র ছেলে। সেই সম্পর্ক ধরে আমি ওঁর মামাশ্বশুর। তুতু-র বয়স যখন সাত কি আট, তখন আমার মাকে নিয়ে ওদের বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। কী সুন্দর বাড়ি ছিল ওখানে। মনে আছে একটা পুকুরও ছিল সে বাড়িতে। তবে সুচিত্রা আর তুতুর বিয়ের সময় আমার যাওয়া হয়নি। আমাদের আত্মীয়তার গল্প কোনও দিন আমি ইন্ডাস্ট্রিতে করিনি। তাই বোধহয় অনেক বছর পরে মিসেস সেন জানতে পেরেছিলেন সে কথা। কাজ করার সময় যখন দেখা হত, তখন অন্যদের মতো আমিও ওঁকে ‘মিসেস সেন’-ই বলতাম।”
কর্মক্ষেত্রে তাঁদের দেখা হওয়াটাও বেশ অদ্ভুত কারণে।
প্রত্যেক অভিনেত্রীরই একজন প্রিয় চিত্রগ্রাহক থাকেন। মিসেস সেনের নাকি ফেভারিট ছিলেন অনিল গুপ্ত। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ থেকে ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’, ‘চাওয়া পাওয়া’ থেকে ‘স্মৃতিটুকু থাক’ সব সিনেমারই ডিরেক্টর অব ফোটোগ্রাফি ছিলেন অনিল গুপ্ত। “একদিন অনিল আমাকে ডেকে বলল, ‘তুই সুচিত্রার কাজ করিস না!’ উত্তরে আমি বললাম, ‘আমি তো এমনিতেই ওর কাজ করিনি।’ কেন এমন বলছে জানতে চাইলে অনিল বলল যে, ও ঠিক করেছিল যে সুচিত্রাকে নিয়ে একটা সিনেমা পরিচালনা করবে। তার জন্য ডেটও নিয়েছিল। অ্যাডভান্স টাকাও দিয়েছিল। কোনও কারণে শু্যটিং হয়নি সময়মতো, কিন্তু সেই আগাম দেওয়া টাকাটা আর ফেরত পায়নি। তবে আমি তা শুনে বলেছিলাম শুধু এক তরফা কথা শুনলে তো হবে না। আমাকে সুচিত্রার কথাও শুনতে হবে।”
তার পর বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে দেখা। সঙ্গে যাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আবার ইউনিয়নের সদস্য। “প্রথমে দেখা হয় তুতুর সঙ্গে। জানতে পারি যে, টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শ্যুটিং যে হচ্ছে না সেটা মিসেস সেনকে বলা হয়নি। তাই ডেটগুলো ক্যানসেল না করাতে সেগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই নিয়েই ভুল বোঝাবুঝি। সে দিন বাড়িতে মিসেস সেন ছিলেন না। পরে আমার সঙ্গে দেখা হওয়াতে হেসে বলেছিলেন, ‘আপনি আবার গুন্ডা-টুন্ডাদের অ্যাসিসটেন্ট কইর্যা লইয়া আসেন ক্যান?’ স্পষ্ট বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন আমার সঙ্গে। আমি বলেছিলাম, ‘কী বলছি, তার একটা সাক্ষী তো থাকা দরকার!’ বোঝালাম যে মনোমালিন্য না করে যদি মিটমাট হয়ে যায়, তা হলেই মঙ্গল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব মিটমাট হয়ে গিয়েছিল,” বললেন ‘নাগরিক’য়ের চিত্রগ্রাহক।
এর পর অবশ্য দু’জনের দেখা হয়েছিল সেটে। সুশীল মজুমদারের পরিচালনায় ‘শুভরাত্রি’র শ্যুটিংয়ে। স্টুডিয়োর মধ্যে তিনটে বাড়ির মাঝখানে উঠোনএ রকম একটা সেট ফেলা হয়েছিল। ওই সেটের শেষ শট ছিল এইটাই। এ দিকে সে দিন সুচিত্রার মুম্বই যাওয়ার কথা। পরিচালককে নাকি বলেছিলেন, “সুশীলদা, আমার স্বামী অসুস্থ। বাড়িতে গিয়ে ওর জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তার পর এয়ারপোর্টে যাওয়া। রাত আটটায় প্লেন। টাইমের অভাব। আপনি আজকে আমাকে ছেড়ে দিন।”
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রামানন্দবাবু জানান, “সুশীলদা বলেছিলেন একটা এত বড় সেট করতে তিন দিন লেগে যাবে। এবং একটা শটের জন্য সেটা করতে অনেক টাকা খরচ হবে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, কতটা সময় লাগবে আলোটা করতে। আমি বললাম যে রিহার্সাল দিলে তা বুঝতে পারব। জানতাম তিনটে বাড়ির ছাদে উঠিয়ে ইলেকট্রিশিয়ানদের দিয়ে আলোটা করাতে হলে সময় তো একটু লাগারই কথা। শুনে মিসেস সেন বাইরে চলে গেলেন। কিছু ক্ষণ পরে আবার আমাকে প্রশ্ন, ‘রামবাবু, কত দেরি? আমাকে ছেড়ে দিন। হবে না বোধ হয়।’ কী মনে হল জানি না, আমি বললাম, ‘আমার ছেলেগুলি তো বাঁদর নয় যে এত তাড়াতাড়ি সেটের মাথায় উঠবে’।”
সে কথা শুনে পরিচালকের রক্ত গরম। “চিৎকার করে আমাকে বললেন, ‘চুপ করো!’ আমার বেশ অপমানিতই লেগেছিল। তবে লক্ষ করেছিলাম যে মিসেস সেন তাতে লজ্জাও পেয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন যে উনি তাড়া দেওয়ার জন্যই আমাকে ওই রকম কথা শুনতে হয়েছিল। পরে অবশ্য সাউন্ড ডিজাইনার সত্যেন চট্টোপাধ্যায়কে গিয়ে বলেছিলেন, ‘রামবাবু শুধু শুধু আমাকে দুটো কথা শোনালেন। আমি তো শুধু জানতে চেয়েছিলাম কত দেরি হবে...’ এ দিকে যেই মিসেস সেন বাইরে চলে গিয়েছিলেন অমনি সুশীলদা এসে আমাকে জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘তুই কিছু মনে করিস না। আমি ম্যানেজ করলাম। তুই এখন কাজটা উতরে দে’।”
সে যাত্রায় কাজ উতরে যায়। মুচকি হেসে উনি বলেন যে, পরে সত্যেন চট্টোপাধ্যায় নাকি তাঁকে ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে, তুই ফিল্ম লাইনে থাকবি কি না? এই ভাবে মিসেস সেনের সঙ্গে কথা বলছিস!’
গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়িতে বসে ওই একই সময়কার আরেকটা ছবির গল্প করেন রামানন্দবাবু। সিনেমার নাম ‘শিল্পী’। উত্তম-সুচিত্রার হিট ছবি। অগ্রগামীর পরিচালনায় এর আগে কোনও দিন তিনি কাজ করেননি। তখন তিনি টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর অন্যতম কর্ণধার। সিনেমার শ্যুটিং করার জন্য আলাদা করে টাকা নিতেন না। “মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা হতে, উনি আমাকে বললেন: ‘আপনার সঙ্গে ঝগড়া হলেও দেখুন আমি এই পার্টিটাকে এখানে নিয়ে এসেছি’। কয়েক দিন শ্যুটিংয়ের পর হঠাৎ একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘এটা কী শুনছি? আপনি নাকি টাকা নেন না?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম: “আমি একটা টেকনিশিয়ান হয়ে বিনা পয়সায় স্টুডিয়োর ডিরেক্টর হয়েছি। বিনা পয়সায় তো আর ডিরেক্টর হওয়া যায় না। আমি কনট্রিবিউট করছি বাই ওয়ার্কিং ফ্রি’। তা শুনে উনি কালুবাবু (অর্থাৎ অগ্রগামীর একজন পরিচালক সরোজ দে)কে ডেকে বলেছিলেন, ‘রামবাবু টাকা নিচ্ছেন না।
আপনাদের সিনেমা দেখিয়ে টাকা ওঠার পর ওঁকে রেমুনারেশন দেবেন’,” তিনি বলেন। শ্যুটিংয়ের সময় একদিন উত্তম-সুচিত্রা একই ফ্রেমে। “খুব নিকট শট। দু’জনে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। কিন্তু ফ্রেমিংটা ভাল হচ্ছিল না। রিহার্সালে দেখা গেল উত্তমের ফ্রেমটা ঠিক আসছে। কিন্তু মিসেস সেনের শুধু মুখটুকু আসছে। তাই কম্পোজিশনটা খুব বেমানান। মিসেস সেনের গলা, কাঁধ আর মাথা দেখানোটা জরুরি। আমি কিছু ইট পেতে দিলাম। দশ ফুট পথ যাতে সেই ইটের ওপর দিয়ে মিসেস সেন হেঁটে যেতে পারেন। কিন্তু উনি রাজি নন। আমি তখন পা দিয়ে ইটগুলো সরিয়ে দিলাম। তার পর ‘সলিলোকি’র মতো করে বললাম, ‘ইটগুলো কে যে পেতেছে...’ আমার কথা শুনে মিসেস সেন কিছু ক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘না না, পেতে দিন। আমি হাঁটব’!” বললেন ‘নিশীথে’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘হেডমাস্টার’য়ের চিত্রগ্রাহক।
আরও এক বার শ্যুটিংয়ের সময় একটা মজার ঘটনা হয়েছিল। কোন সিনেমার ঘটনা সেটা মনে করতে পারছেন না। তবে বলছেন, “একদিন মিসেস সেন সেটে এলেন প্রচুর রুপোর গয়না পরে। আমি গিয়ে বললাম, ‘এই গয়না পরে আপনাকে বেশ ভালই লাগছে দেখতে। কিন্তু এই চরিত্রে এ ভাবে সাজলে কেমন যেন গয়নার বিজ্ঞাপন মনে হচ্ছে’। শুনে উনি আমাকে কিছু সিনেমার নাম বললেন, যেখানে উনি ও ভাবে সেজেছিলেন। সব শুনে আমি বললাম, ‘আমার মনে হয়েছে, তাই এটা বলেছি। সাজেশনটা নেবেন কি না সেটা আপনার ব্যাপার’। কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার পর ‘দাঁড়ান, আসছি’ বলে গয়না খুলে এলেন। পরে এলেন সাধারণ সব গয়না।”
শ্যুটিং করার সময় উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই ছিল। “দে ওয়্যার ফ্রেন্ডস। নিজেদের মধ্যে ইয়ার্কিও হত। কিন্তু বাইরের লোক এসে শ্যুটিং দেখুক, তা উনি পছন্দ করতেন না। আজও যেমন পর্দার আড়ালে আছেন, তখনও খানিকটা তাই ছিলেন। আমি জানি মিসেস সেন খুব ভাল ছবি আঁকতেন, গান গাইতেন এবং নাচতেনও,” বলেন ‘শিল্পী’র চিত্রগ্রাহক।
এর পর আরও একটা ছবি করার কথা হয়েছিল। কিন্তু রামানন্দবাবু তখন অন্য একটা শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত। “হঠাৎ সে সিনেমার হিরোইন নিখোঁজ। এ দিকে মিসেস সেন চাইছেন উত্তম আর ওঁকে নিয়ে অন্য একটা সিনেমায় যাতে আমি কাজ করি। উনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে ডেট অ্যাডজাস্ট করব। কিন্তু উত্তমকুমারের ডেট অনুযায়ী আপনাকে ডেট দিতে হবে’। দুর্ভাগ্যবশত যখন ডেট ঠিক হল, তখন দেখি সেই নিখোঁজ হিরোইন আবার ফিরে এসেছেন। তাই সেই ছবিটা আর করা হল না।”
কেরিয়ারের শেষ দিকে নাকি আরও একটা মজার কাণ্ড করতেন সুচিত্রা সেন। “এই বুড়ো বয়সেও মিসেস সেনের গলাটা কানে বাজে। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই আমাদের ইচ্ছে করত ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে। সেই সময় উনি সুর করে বলতেন: ‘আমি বাড়ি যাব... আমি বাড়ি যাব... আমি বাড়ি যাব!’ একদম বাচ্চাদের মতো। গোটা ইউনিট সেটা খুব উপভোগ করত। দারুণ ভাল লাগত ওঁর ওই আদুরে গলায় বাড়ি যাওয়ার আবদারটা শুনতে। আজও বাড়িতে একা একা বসে ওই সুরটা যখন কানে বাজে, আমি সেটাকে নিজেও রিপিট করি। আমারও তো বয়স হয়েছে... তাই আমিও আজ বাড়ি যেতে চাই...”।
তবে সে কথা শুনছে কে?
সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দুই শিল্পী।
এক স্টার। আর এক চিত্রগ্রাহক।
অসুস্থতা সারিয়ে রোগ-ব্যাধিকে দূরে সরিয়ে, দু’জনেই যেন সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকে যান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.