সদ্যোজাত শিশুদের মৃত্যু ঠেকাতে চালু হয়েছিল ২৪ ঘণ্টা যুদ্ধকালীন তৎপরতার বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা। কিন্তু বাদ সাধছে ডাক্তারের অভাব। যখন-তখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ) নামে পরিচিত ওই চিকিৎসাকেন্দ্রগুলির অস্থায়ী ডাক্তারেরা। ফলে, পরিষেবা ধাক্কা খেতে বসেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থায়ী পদ সৃষ্টির কথা ভাবছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
বাম আমলেই এসএনসিইউগুলির কার্যকারিতা বাড়ানোর পথে পরিকাঠামোর সমস্যা টের পেয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। তাই তখন আর এসএনসিইউ খোলা হয়নি। বহু দিন পর্যন্ত রাজ্যে মাত্র ছ’টি এসএনসিইউ ছিল। কিন্তু ২০১১-১২ সালের কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার বাড়ায় (প্রতি দশ হাজারে ৩১ জন থেকে বেড়ে হয় ৩২ জন) আর ঝুঁকি নিতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। এসএনসিইউ বাড়াতেই হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে।
গত দু’বছরে এসএনসিইউ-এর সংখ্যা ছ’টি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬টি। সরকারের লক্ষ্য, পরের দু’বছরে মোট ৫৮টি এসএনসিইউ চালু করা। ২০১৪ সালের মার্চের ভিতরেই এর মধ্যে নতুন ৯টি কেন্দ্রে পরিষেবা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু ডাক্তার মিলবে কোথায়? অস্থায়ী যাঁদের নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা কেউ পাঁচ-ছ’মাসের বেশি টিকছেন না। ডাক্তারের অভাব সামাল দিয়ে এই বিপুল কর্মভার সামাল দিতে এখন এসএনসিইউগুলির জন্য ডাক্তার-নার্সদের স্থায়ী পদ তৈরির কথা ভাবছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
সরকারি সূত্রের খবর, মূলত এক বছরের চুক্তিতে নেওয়া মেডিক্যাল অফিসারদের দিয়েই এই কেন্দ্রগুলি চালাতে চেয়েছিল রাজ্য। কিন্তু তাঁরাই যখন-তখন চাকরি ছাড়ছেন। ফলে দু’জন বা তিন জন ডাক্তারের উপরে যাবতীয় চাপ এসে পড়ছে। শহরে বা শহরের কাছাকাছি বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেশি মাইনের চাকরি কিংবা এমডি তথা উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পেয়েও এসএনসিইউ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন ডাক্তারেরা। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, “অস্থায়ী ডাক্তারদের অনেককে শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার বিশেষ তালিম দেওয়া হয়েছিল। তালিম-টালিম নিয়ে তাঁরা কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় সব ভণ্ডুল।”
রাজ্যে শিশু ও মায়েদের মৃত্যু রুখতে গড়া টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ৪৫-৫৫ হাজার টাকা মাইনে দিলেও ডাক্তারেরা থাকছেন না। তাই অস্থায়ী চিকিৎসকদের পদটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে। ত্রিদিববাবুর কথায়, “হেল্থ সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট বোর্ড-এর মাধ্যমে ৩১২ জন স্থায়ী চিকিৎসক ও ৬৪০ জন স্থায়ী নার্স নিয়োগ করা হবে। নবান্নের সবুজ সঙ্কেতও মিলেছে। স্থায়ী চাকরি পেলে কেউ সরকারি চাকরি ছাড়তে চাইবে না।”
এখন এসএনসিইউগুলিতে ১০৮ জন স্থায়ী চিকিৎসক ও চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত ৭০ জন অস্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু থাকার কথা অন্তত ২২০ জন চিকিৎসকের। নার্সেরও অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত নভেম্বরে ৮৬ জন অস্থায়ী মেডিক্যাল অফিসারকে এসএনসিইউ-এর জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন কাজে যোগই দেননি। দুর্গাপুর, উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর, মুর্শিদাবাদের কান্দি, উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের মতো অনেক এসএনসিইউ-তে সাকুল্যে দু’জন ডাক্তার রয়েছেন। ১৯ জানুয়ারি এমডি পরীক্ষায় ফল বেরোলে, তাতে সুযোগ পেয়ে আরও বেশ ক’জন ডাক্তার চাকরি ছাড়তে পারেন বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্যকর্তাদের।
কিন্তু স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেও কি সমস্যা মেটানো যাবে? শহরের চাকরির সুবিধা ছেড়ে এসএনসিইউ-এর ঝক্কির কাজে প্রত্যন্ত গ্রামমুখী হবেন ডাক্তাররা? মুর্শিদাবাদ জেলার এসএনসিইউ থেকে চাকরি ছাড়া জনৈক ডাক্তারের কথায়, “অজ পাড়াগাঁয়ে কাজ করা ছাড়াও এসএনসিইউ-তে চাপ বেশি। মরণাপন্ন বাচ্চারা আসে। ২৪ ঘণ্টা তটস্থ হয়ে থাকতে হয়। স্বাভাবিক জীবন মাথায় ওঠে। একটি-দু’টি বাচ্চা মারা গেলেই হইচই, নেতা-মন্ত্রীর চাপ, শো কজ। কে অত ঝামেলা নেবে? তার থেকে একই মাইনেতে শহরে ঝামেলামুক্ত কাজ পাওয়া যায়।”
|