সুবিধা দারিদ্রসীমার উপরেও
এ বার বিনে পয়সায় ওষুধ মিলবে গ্রামে
রকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রশংসা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালে গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে সব রোগীকে বিনামূল্যে জীবনদায়ী ও অত্যাবশ্যক ওষুধ ও সেই সঙ্গে রক্ত-সহ রোগ-নির্ণয়ের বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ও এক্স-রে পরীক্ষার পরিষেবা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার ফেসবুকে এই নয়া সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, কয়েক দিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ জারি হবে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যের ৯০৯টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৭৯টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ২৬৯টি গ্রামীণ হাসপাতালে একসঙ্গে এই পরিষেবা দেওয়া শুরু হবে।
ফেসবুকে মমতা একে সরকারের ‘যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করছেন। তামিলনাড়ু ও রাজস্থানে অবশ্য আগে থেকেই সবাইকে নিখরচায় ওষুধ দেওয়ার চালু রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় ২০১৬-র মধ্যে দেশের সবাইকে নিখরচায় ওষুধ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই জন্য যা খরচ হবে তার ৮৫% দেবে কেন্দ্র ও বাকি ১৫% দিতে হবে রাজ্যকে। চলতি বছরে গোটা দেশের জন্য কেন্দ্র এই খাতে বরাদ্দ করেছে ৩০ কোটি টাকা।
রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় এত দিন কোনও স্তরেই ওষুধ বিলির ক্ষেত্রে কোনও লিখিত সরকারি ফরমান ছিল না। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, গোটা বিষয়টিই এত দিন ছিল নীতি-ভিত্তিক। কোনও লিখিত সরকারি নির্দেশ ছিল না। মমতা সেই কাজটিই খাতায়-কলমে করছেন। এর সঙ্গে উপরি পাওনা হল গ্রামীণ স্তরে দারিদ্রসীমার উপরের লোকজনকেও নিখরচায় যাবতীয় পরিষেবা দেওয়ার বিষয়টি।
এত দিন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সব ক্ষেত্রেই রোগীদের দাম দিয়েই অনেক জরুরি ওষুধ কিনতে হত। বিপিএল তালিকাভুক্তদের ছাড় দেওয়ার মৌখিক নিয়ম চালু থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেই ছাড় মিলত না। আবার দাম দিয়েও অনেক জায়গায় ওষুধ মেলে না। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণায় সেই রেওয়াজে বদলের আশা করছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য কর্তারা জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক স্তরে যে হেতু ন্যায্য মূল্যের ওষুধ পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই, ফলে বেশি দাম দিয়েই অত্যাবশ্যক ওষুধ কিনতে হয় গ্রামের মানুষদের। নতুন নীতিতে দারিদ্রসীমার নীচে-উপরের সব গ্রামীণ মানুষই লাভবান হবেন। বাম আমলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের অবশ্য বক্তব্য, “আমাদের সময়েই তো প্রাথমিক স্তরের হাসপাতালে রোগীরা নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা ও ওষুধ পেতেন। মহকুমা থেকে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত আউটডোর-ইমার্জেন্সিতে নিখরচায় ওষুধ দেওয়া এবং ওই হাসপাতালে ভর্তি বিপিএল রোগীদের বিনা পয়সায় পরিষেবা দেওয়াটাই রীতি ছিল। তৃণমূল এখন একে নতুন বলে দাবি করলে কিছু বলার নেই।”
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণায় উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। বিপুল পরিমাণ ওষুধ সংগ্রহ, সেগুলি মজুত করা, প্রয়োজন অনুয়ায়ী রাজ্যের সর্বত্র তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো কি রাজ্যের আছে? এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজ্য কী পরিকল্পনা নিচ্ছে? কোথায় ওষুধ পড়ে রয়েছে অথচ অন্যত্র মানুষ তার জন্য হন্যে হচ্ছেন কি না, কোথাও ‘ওষুধ নেই’ বলে রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না— এই সব বিষয়ে নজরদারির বন্দোবস্ত কি করছে রাজ্য সরকার? সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এ সবের উত্তর থাকবে কি না, এখন তারই অপেক্ষা। গ্রামীণ স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একাংশ এ দিন স্পষ্টই বলেছেন, উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে না তোলা পর্যন্ত এই প্রয়াস পুরোপুরি সফল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র সুমন বিশ্বাসের দাবি, “ওষুধের জন্য টাকার কোনও অভাব হবে না। ২০১০ সালে যেখানে ওষুধ কেনার জন্য সরকারি বাজেট ছিল ৮০ কোটি টাকা, সেটাই ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবর্ষে অঙ্কটা আরও ২০০ কোটি বাড়বে বলে ঠিক হয়েছে।”
প্রশ্ন রয়েছে ফার্মাসিস্টের অভাব নিয়েও। প্রায় ১৫ বছর রাজ্যে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বন্ধ। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য কিছু দিনের মধ্যেই ৫০০ জন অস্থায়ী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন। ওষুধ না পেলে মানুষ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে অভিযোগ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
পরিকাঠামো ও টেকনিশিয়ানের অভাবে রাজ্যের অধিকাংশ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালে এখনও রক্ত, লালা ইত্যাদি পরীক্ষা এবং এক্স-রে চালু করা যায়নি। এই অবস্থায় নতুন নীতি কার্যকর করা হবে কী ভাবে? কত দিনে? এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিকর্তার জবাব, “ধীরে ধীরে সব হবে। আমরা কিছু দিনের মধ্যে আরও ৫০০ টেকনিশিয়ান নিচ্ছি। রক্ত পরীক্ষা ও এক্স-রে করার যন্ত্রও কেনা হচ্ছে। এর ফলে ৩৪৮টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালেই সব ধরনের রক্তপরীক্ষা ও এক্স-রে শুরু হবে।”
এতেও নিঃসংশয় হতে পারছেন না গ্রামের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক স্বাস্থ্য কর্তা যেমন বলেন, “আগে থেকে চেয়ে পাঠালেও ‘ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ স্টোর্স’ থেকে সব সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। শিশু ও মহিলাদের ওষুধ ছাড়া অন্য রোগের ওষুধ প্রায় থাকেই না। সবাইকে নিখরচায় ওষুধ দেওয়া শুরু হলে চাহিদা অনেক বাড়বে। তখন যাতে ওষুধ সরবরাহ স্বাভাবিক হয় তা দেখতে হবে।” নদিয়ার এক স্বাস্থ্য কর্তা বললেন, “ব্লক স্তরে রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থাকলেও সব পরীক্ষা হয় না। নিখরচায় পরিষেবা শুরুর আগে সব পরীক্ষা চালু করতে হবে।”
তবে খামতির আশঙ্কা থাকলেও নিখরচায় ওষুধ সরবরাহ নিয়ে সরকারি নির্দেশ জারির পরে প্রশাসনের কর্তাদের দায়বদ্ধতা থেকে যাবে বলে মনে করছেন অনেকে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানান, আপাতত সরকারি তালিকায় প্রায় ৬০০ ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ হাসপাতাল, মহকুমা বা জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে কোন কোন অত্যাবশ্যক ওষুধ দরকার— তার পৃথক তিনটি তালিকা তৈরি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল স্তরে মোটামুটি ২০০টি অত্যাবশ্যক ওষুধ দরকার। সেখানকার চিকিৎসকরা এ বার থেকে শুধু সেই ওষুধগুলিই প্রেসক্রিপশনে লিখবেন। ওষুধের ভাঁড়ার পুরোপুরি ফুরোনোর আগেই পরবর্তী স্টকের জন্য স্বাস্থ্য ভবনে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। হাসপাতালের ভাঁড়ারে কোনও ওষুধ বেশি দিন পড়ে থাকলে স্বাস্থ্য ভবনে বসে অনলাইন তা দেখে নিতে পারবেন কর্তারা।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন আরও জানান, বাঁকুড়া, মালদহ ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের পরিষেবা উন্নয়নে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ৯০ কোটি দেবে রাজ্য, ৩৬০ কোটি টাকা দেবে কেন্দ্র। স্বাস্থ্য ভবনের খবর, এই টাকায় অঙ্কোলজি নেফ্রোলজি, পেডিয়াট্রিক সার্জারির মতো পরিষেবা শুরু করার কথা। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, এই সবের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কোথায়? স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, যে কারণে রাজ্যে যে ৩৫টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল আড়াই বছরেও চালু করা যায়নি। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যেপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “মেডিক্যালে স্নাতকোত্তরে আসন অনেক বেড়েছে। তিন বছর পরে আর বিশেষজ্ঞের অভাব থাকবে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.