আমার নিজের কোনও কাকা ছিল না বটে, কিন্তু আমার রেলতুতো কাকু অগুনতি। বদলি হয়ে হয়ে আমরা এক জায়গা থেকে অন্য নানা জায়গায় চলে যেতাম এবং নতুন নতুন কাকু জুটে যেত। লাহিড়িকাকু যেমন। রোগা, বেঁটে, ক্ষয়াটে, ফোকলা এক জন মানুষ। প্রথম পক্ষের ছেলে আর দ্বিতীয় পক্ষের বউ নিয়ে তাঁর সংসার। ছিলেন রেলের গার্ড। এমনিতে মানুষ কিছু খারাপ নন, কিন্তু সন্ধের পর প্রায় চুরচুর মাতাল হয়ে কোয়ার্টারে ফিরতেন। খুব হাল্লাচিল্লা মাচাতেন, পাতের ভাত তরকারি মাছ বাতাসে ওড়ানোর চেষ্টা করতেন। রোগা মানুষটা ওই সময়ে বীর হয়ে উঠতে চেষ্টা করতেন। এ গল্প লাহিড়িকাকুর নয় আসলে। লাহিড়ি-কাকিমার। ভারী রোগাভোগা, বড্ড ভালমানুষ আর বোকাসোকা এই কাকিমাটি তাঁর সতিনের ছেলেটাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতেন, আর বাবলুও তার এই মায়ের অন্ধ ভক্ত ছিল। কাকিমার সঙ্গে কাকুর কখনও ঝগড়া, মতান্তর, মনান্তর ছিল না। আমার বিশ্বাস, কাকিমা জানতেনই না ঝগড়া কী করে করতে হয়।
আমার নিজের মাকে আমি কখনও খুব একটা রেগে যেতে দেখিনি। রাগ করার খুব কারণ ঘটলে মা বকাঝকা করত বটে, কিন্তু চেঁচামেচি কক্ষনও নয়। আর লাহিড়ি-কাকিমার ওই বকাঝকাটুকুও ছিল না। সংসার এমনিতেই সচ্ছল নয়, তার ওপর কাকুর মদের নেশায় বিস্তর খরচ হত বলে প্রচণ্ড টানাটানির মধ্যেই কাকিমা সংসার চালাতেন। কিন্তু কক্ষনও কাকুর সম্পর্কে কোনও নিন্দাবাক্য উচ্চারণও করতেন না। আমরা ঘরে গিয়ে দেখেছি, কত সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে কী সুন্দর গুছিয়ে সংসার করতেন কাকিমা। মুখে বিরক্তি নেই, ভ্রুকুটি নেই। বরং কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে থাকতেন।
পাউরুটি বাসি হলে টুকরোগুলো উনুনের বাইরের দিকে লাগিয়ে রেখে দিতেন। অনেক ক্ষণ মৃদু আঁচে গরম হয়ে হয়ে তা মুচমুচে টোস্ট বিস্কুট হয়ে উঠত। আমাদের বাড়িতে কত বার নিয়ে এসেছেন ওই সুস্বাদু টোস্ট বিস্কুট। কী যে ভাল লাগত খেতে!
কোনও ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞান জানা ছিল না তাঁর। পয়সার হিসেব করা ছাড়া অঙ্কের পারদর্শিতা ছিল না। গুণহীনা, অবিদুষী এই মহিলা তবু কী অনায়াসে মাতাল স্বামী আর সতিনপোকে নিয়ে একটা ভারী শ্রীমণ্ডিত, শান্ত, পরিচ্ছন্ন সংসারকল্প চালিয়ে নিতেন! মাঝে মাঝে মনে হয়, জ্ঞানী মানে কি সবজান্তা? যার যেটুকু জানলে চলে তার বেশি জানা কি খুব দরকার? |
দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে আসতেন। বাইরে কটকটে রোদ, তবু এসেই বলতেন, ওই দেখেন দিদি, বৃষ্টি আসতেছে! মা অবাক হয়ে বলত, কোথায়! বাইরে তো রোদ! কাকিমা কিছু বলতেন না। তাঁর তো কিছুই কারও কাছে প্রমাণ করার ছিল না। তবে বোধহয় ঝড়বৃষ্টির প্রতি অমূলক একটা ভয় ছিল।
এক দিন মা আমাদের বলল, ওরে, আমি কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি যে, আমি দুধ দিয়ে রেণুর মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি। শুনে তো আমরা হেসে বাঁচি না। আমি বললাম, মা, দুধ দিয়ে কাকিমার মুখ ধোয়ালে কিন্তু কাকিমা আর এ বাড়ির ছায়াও মাড়াবে না। দুধ দিয়ে মুখ ধোয়া মোটেই ভাল ব্যাপার নয়। মা মুখ চুন করে বলল, তা তো বুঝলুম বাবা, কিন্তু ভাবছি স্বপ্ন যখন দেখলুম তখন না ধোয়ালে যদি অমঙ্গল হয়? লাহিড়ি-কাকিমা, অর্থাৎ আমার মায়ের রেণু, কিন্তু স্বপ্নের কথা শুনে খুব খুশি। একেবারে ডগোমগো। কেউ যে তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে এতেই কাকিমা কৃতার্থ। এবং শেষ পর্যন্ত দুধ দিয়ে মুখ ধোয়ানোর পর্বটিও ঘটেছিল। এবং কাকিমা হাসিমুখেই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন।
বেশি কথা কখনও তাঁকে বলতে শুনিনি। বড় জোর কী রাঁধলেন, কী ভাবে রাঁধলেন বা কী মাছ এসেছিল এই সব। সেই সব কথা এতই সামান্য যে আমাদের জাতীয় প্রগতিতে তার কোনও ভূমিকা নেই। তুচ্ছ কথা। তুচ্ছ জীবন, কোনও মহত্ত্ব নেই, সৃজন নেই, শিল্পও নেই।
তবু কিছু একটা আছে। না থাকলে এত দিন ধরে এই কাকিমাকে আমার মনে থাকত না। হয়তো বাড়াবাড়িই হবে, তবু বলি, আমার এই রেলতুতো অনামা কাকিমা যেটুকু জানতেন সেটুকুর সামনেই অনেক মহাজ্ঞানীকেও নতজানু হয়ে বসতে হবে। এঁর কাছে যেন আমাদের অনেক কিছু শেখার ছিল।
কাকুটি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার পিতৃদেব তাঁর বস। কাকু মায়ের সঙ্গেই বসে গল্প করতেন। তিনি জানতেন, মাতাল বলেই তাঁকে সবাই একটু নিচু নজরে দেখে। এ বাবদে তাঁর একটু আত্মগ্লানিও ছিল। লাহিড়ি-কাকিমার ওপর তাঁর অত্যাচার মা পছন্দ করত না। সে জন্য মাঝে মাঝে মা কাকুকে মৃদু বকাঝকাও করেছে। কাকু তখন তটস্থ হয়ে বলতেন, ওর কথা ছেড়ে দিন। ও তো পান্তাভাত। শুনে আমার কাকুর ওপর রাগ হত। মানুষ আসলে কী চায়, তা সে বেশির ভাগ সময়েই বুঝে উঠতে পারে না। একই নারীর মধ্যে প্রেমিকা, সেবিকা, মোহিনী, বশংবদ, যৌনতাপ্রবণ ও নিস্পৃহ খুঁজলে তো হবে না। পুরুষের অবুঝপনা বোধহয় কোনও দিনই ঘোচার নয়। কাকিমার নিন্দেমন্দ করলে আমার মা কাকুর ওপর অসন্তুষ্ট হত এবং রেণুর পক্ষ নিয়ে বকাঝকাও করত। তখন মুখ চুন করে চলে যেতেন কাকু।
This is the way the world ends
Not with a bang but a whimper — ঠিক এ ভাবেই পৃথিবীর নিরীহ, মুখচোরা মানুষেরা চলে যায়। ঠিক এ ভাবেই লাহিড়ি-কাকিমাও চলে গেলেন। যেন চুপটি করে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো। মরাটা যেন ঠিক মরার মতো হল না। রাতে ঘুমোতে গেলেন। সকালে আর উঠলেন না। ডাক্তার-বদ্যি ডাকতে হল না, অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগল না, হাসপাতালে নিতে হল না, কাউকে বিড়ম্বনা পোহাতে হল না।
কাকিমা মারা যাওয়ার দিন তিনেক বাদে নাবালক পুত্রটিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন কাকু। চোখ জবাফুলের মতো লাল। বাক্যহারা। কান্নায়, হেঁচকিতে, দিশাহারা চাউনিতে যেন দু’দিনেই আমূল বদলে গেছে লোকটা। রেণু নেই— এই কথাটা যেন কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। অত গভীর শোক আমি আর কারও কখনও দেখিনি।
সে দিন মনে হয়েছিল, কাকিমার বেঁচে থাকাটা যত তুচ্ছ ভেবেছিলাম, তত তুচ্ছ তো ছিল না। |