তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়ির পুকুরে কোমরজলে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন বামণি ওঁরাও। ভয়ে এবং ঠান্ডায়!
ভয় করবে না?
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা। কয়েক হাত দূরেই পাড়ে তখনও দাপাচ্ছে দাঁতাল হাতি। ঘন কুয়াশায় কখনও মনে হচ্ছে, একটা ছোটোখাটো পাহাড় লাফাচ্ছে। হুঙ্কারে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। তবে সেই ভয়ও মাঝে মাঝে ভুলিয়ে দিচ্ছে জানুয়ারির জলপাইগুড়ির কনকনে ঠান্ডা!
আধ ঘণ্টা আগেই অবশ্য খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে শুয়েছিলেন বামণিদেবী ও তাঁর স্বামী সানি ওঁরাও। আলিপুরদুয়ারের বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পোরো বিটের ফোস্কারডাঙা গ্রামে ওই দম্পতির বাস। তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে ৮ বছরের সুব্রত, ১৩ বছরের ইন্দ্রজিৎ ও ১৮ বছরের রেণুকাও তখন ঘুমিয়ে কাদা। চোখ প্রায় লেগে এসেছে বামণিদেবীর, এমন সময় হঠাৎই টিনের চালা ভাঙার বিকট শব্দ। ঘুমচোখে দেখেন মস্ত এক দাঁতাল তাঁদের ঘর ভাঙছে। দেখেই চিৎকার জোড়েন বামণিদেবী। ঘুম ভেঙে যায় সকলেরই। ততক্ষণে রান্না ঘরের দরমার বেড়া শুঁড় দিয়ে টেনে ভাঙছে ওই দাঁতাল।
আর দেরি করেননি বামণিদেবী। ঘরের অন্য দিকে বাঁশের বাতা দিয়ে আটকানো জানলাটি নিজেই ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেন। জানলা দিয়েই বের করে দিলেন তিন সন্তানকে। তারপরে পিছনের মাঠ দিয়ে রুদ্ধশ্বাস দৌড়। তাঁদের পালাতে দেখে পিছু ধাওয়া করে হাতিটিও।
বামণিদেবীর কথায়, “তিন সন্তানকে টেনে-হিঁচড়ে কোনও মতে দৌড়ে নামি বাড়িরই পুকুরে। হাতিটাও তাড়া করছিল। তবে পুকুর পাড় প্রায় পঁচিশ ফুট খাড়া থাকায় হাতিটা নামতে পারেনি।” ঘর থেকেই সানিবাবু দেখেন, হাতি স্ত্রী-সন্তানদের পিছু নিয়েছে। তিনি পড়ি-কি-মরি করে বেরিয়ে পড়শিদের ডাকতে ছোটেন। কোমরজলে তখন দাঁড়িয়ে বামণিদেবী ও তাঁর তিন সন্তান।
ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন খেয়াল নেই। বামণিদেবীর কথায়, “প্রতিটা মুহূর্তই মনে হচ্ছিল যেন এক-এক ঘণ্টা। ঠান্ডায় কোমরের নীচ থেকে অসাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়।”
এমন সময় পড়শিদের ডেকে ফিরে আসেন তাঁর স্বামী। অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মী সানি বলেন, “পাড়ার বাসিন্দারা মশাল জ্বালিয়ে, টিন বাজিয়ে, পটকা ফাটালে হাতিটি কিছুটা দূরে সরে যায়। আমিও খানিক হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।”
হাতিটি কিছু দূরে সরে যেতেই দুই ছেলেকে নিয়ে একপাড় দিয়ে উঠে আসেন বামনি। কিন্তু রেণুকা অন্য দিক দিয়ে উঠতে যেতেই হাতিটি ফের তেড়ে আসে তাঁর দিকে। শুঁড় দিয়ে ধাক্কাও মারে। রেণুকার চিৎকারে বাসিন্দারা মশাল উঁচিয়ে তেড়ে যান। তাতে ঘাবড়ে গিয়ে হাতিটি পালায়। জখম রেণুকাকে শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর অপূর্ব সেন বলেন, “হাতিটা ওই এলাকায় মোট তিনটি ঘর ভাঙে। ওই কিশোরীর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে।”
রাতের ঘটনার পর ভিজে কাপড় ছেড়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে রাত কাটায় পরিবারটি। শনিবার সকালেও তাঁদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। ইন্দ্রজিতের কথায়, “বাড়িতে যদি ফের হামলা করে হাতিটা!” সানিবাবুর ক্ষোভ, “এলাকায় প্রায় প্রতি রাতেই হামলা করছে হাতি। ঘর ভাঙছে। অথচ, বন দফতর নির্বিকার।” অভিযোগ না মানলেও বন দফতরের অফিসারদের বক্তব্য, ওই এলাকায় বাসিন্দাদের আরও পটকা ও সার্চ লাইট দেওয়ার জন্য তাঁরা বন-কর্তাদের বলবেন। |