সময় বাঁচাতেই সময় বদলাতে চায় অসম, উৎসাহী নয় রাজ্য
রাত প্রায় আটটা। কলকাতায় অর্ধেক শহর তখন অফিস সেরে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। আরব সাগরের তীরে মুম্বইয়ের জুহু বিচে কিন্তু সূর্যের আলো তখনও নেভেনি।
ভোর চারটে। দেশের পূর্ব প্রান্তে কোহিমা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আলো। উল্টো দিকে, গুজরাতের পোরবন্দরে মাঝরাতের মতো ঘন অন্ধকার!
এই পুরো কাণ্ডের পিছনে আছেন এক জনই! তিনি ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ বা ভারতীয় প্রামাণ্য সময়। যা হিসেব করা হয় ইলাহাবাদের স্থানীয় সময়কে প্রামাণ্য ধরে। এর ফলেই যত গণ্ডগোল। কিন্তু কেন এই ফারাক?
পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলেই দিনরাত হয়। পূর্ব দিকে সবার আগে সূর্যের আলো পড়ে। তার পর সেই আলো ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে। পৃথিবীতে সব থেকে আগে সূর্যোদয় হয় জাপানে। আর ভারতে প্রথম সূর্যের আলো পড়ে অরুণাচলে। তার পরে নাগাল্যান্ডের কোহিমায়। দেশে সব থেকে পরে সূর্যের মুখ দেখে গুজরাতের পোরবন্দর ও দ্বারকা। তাই নাগাল্যান্ডে ভোর হওয়ার সময় গভীর আঁধারে ডুবে থাকে গুজরাত।
শিলংয়ে সকাল সাতটাতেই রোদের তেজ দেখে সময় গুলিয়ে ফেলেন কলকাতার পর্যটকেরা। অমৃতসরে তো অন্ধকার নামার আগেই খিদে মালুম হয়।
এই সব মজার অভিজ্ঞতার মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হল বিদ্যুতের সাশ্রয়। ভারতীয় প্রামাণ্য সময় থেকে ঘণ্টাখানেক এগিয়ে থাকা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত আলো জ্বালাতে হয়। পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে আবার ভোর থাকতে উঠে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয় আম-জনতাকে। ফলে দু’ক্ষেত্রেই সূর্যের আলো ঠিকঠাক কাজে লাগে না। বাজে খরচ হয় বিদ্যুতেরও। এ জন্য পূর্বের রাজ্যগুলিকে নিয়ে নতুন ‘টাইম জোন’ বা সময়-অঞ্চল গড়ার প্রস্তাব আসে ১৯৪১ সালেই। কিন্তু নানা টালবাহানার পরে তা আর হয়ে ওঠেনি। এ বারে একই যুক্তি দেখিয়ে সম্প্রতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঞ্চলিক সময় চালুর দাবি জানিয়েছে অসম। এই দাবিতে তারা পাশে চায় পশ্চিমবঙ্গকেও। যদিও এ রাজ্যের সরকার এমন প্রস্তাব বাস্তবসম্মত বলে মনে করে না।
আঞ্চলিক সময় চালুর দাবি নিয়ে গত বছর জুলাইয়ে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের কাছে গিয়েছিলেন অসমের ১৫ জন বিধায়ক। অসমের এই দাবির পক্ষে অনেকেই যুক্তি দেখিয়েছেন, আমেরিকা, রাশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় একাধিক আঞ্চলিক সময় আছে। তা হলে ভারতে হবে না কেন!
ভারতে একাধিক সময়-অঞ্চল কিন্তু নতুন নয়। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি অবিভক্ত দেশের সব প্রদেশের নিজস্ব সময় চালু হয়। রেল ও ডাক বিভাগের মতো সর্বভারতীয় ব্যবস্থাগুলি তখন মাদ্রাজের সময় মেনে চলত। ১৮৮০-র আগে অবশ্য কলকাতার সময় মেনেই চলত দেশের বেশির ভাগ প্রদেশ।
১৯০৬ সালে অভিন্ন ভারতের প্রামাণ্য সময় (আইএসটি) তৈরি হয়। এর পরে দু’বার অদলবদল হলেও ১৯৪৫ সালে ফের গ্রিনিচের থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে থাকা ভারতীয় প্রামাণ্য সময়েই ফিরে আসে দেশ। সেই ব্যবস্থাই এখনও চলছে।
এ বারে সেটাই বদলানোর দাবি তুলল অসম। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছেন, “উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কাজের সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে নতুন সময়-অঞ্চল (টাইম জোন) করুক কেন্দ্র।” এর মধ্যেই রাজ্যের চা বাগানের সময় মেনে সরকারি কাজ শুরু করেছে তারা। ব্রিটিশ আমলে অসমের চা বাগানে কাজের সুবিধার জন্য স্থানীয় সময় ধরে তৈরি করা হয়েছিল এই ঘড়ি।
বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের ন্যাচারাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ সেনগুপ্তও মনে করেন, আধ ঘণ্টা সময় এগিয়ে আনলেই দেশে বছরে দু’শো কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ বাঁচবে। যা দেশের মোট ঘাটতির প্রায় সমান। বিদ্যুৎ মন্ত্রকও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সকাল সাড়ে ৯টার মানে হবে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সকাল ১০টা। এর ফলে উত্তর ও পশ্চিমে যখন সরকারি অফিস খুলবে, তত ক্ষণে পূর্বে কাজ হয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টা। আর যখন সেখানে অফিস বন্ধ হবে, তার আধ ঘণ্টা আগেই ঝাঁপ ফেলেছে পূর্বের দফতর। ফলে কোনও ক্ষেত্রেই আলো জ্বালিয়ে কাজ করতে হবে না।
পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য অসমের মতো পৃথক সময়-অঞ্চল তৈরিতে উৎসাহী নয়। বরং সরকার মনে করে, বহু দিন ধরেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজ্যবাসীর জীবনযাত্রা তৈরি হয়েছে। তাতে হঠাৎ করে বদলে দিলে গোটা ব্যবস্থাটা তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া, পৃথক সময় চালু করে এ রাজ্যে আদৌ কতটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, তা নিয়েও সংশয় আছে রাজ্যের।
সময় বদলের বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছিল কেন্দ্রও। ২০১২ সালে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের বিপর্যয়ের পর আঞ্চলিক সময় চালু করে বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানোর জন্য কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের ব্যুরো অব এনার্জি অডিটের সচিবকে মাথায় রেখে কমিটিও করা হয়েছিল। যদিও বিস্তর আলোচনা ও দিস্তা দিস্তা প্রকল্প রিপোর্ট তৈরির পরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেন?
এই সংক্রান্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, “কী ভাবে বিদ্যুৎ বাঁচানো সম্ভব, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।” এ প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে অন্য একটা সমস্যার কথা। প্রশাসনের একাংশ মনে করছেন, দেশে পূর্ব থেকে পশ্চিমের সময়ের পার্থক্য দু’ঘণ্টার। আমেরিকা কিংবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় এটা তেমন বেশি নয়। বরং ভারতীয় সময়কে ভাগ করলে তা প্রশাসনিক ও পরিবহণের ক্ষেত্রে সমস্যা করবে। তার চেয়ে ইলাহাবাদের সময়টা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তববাদী। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলেন, “মানচিত্রে অবস্থানের ভিত্তিতে ইলাহাবাদ মোটামুটি ভাবে দেশের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে।” তবে অসমের দাবির প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎসচিব পি উমাশঙ্কর বলেন, “এখনও এমন কোনও প্রস্তাব আসেনি। কোনও রাজ্য এমন প্রস্তাব দিলে কেন্দ্র তা বিবেচনা করবে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.